সাবেক তিন গভর্নরের তথ্য দেওয়া হচ্ছে না দুদককে

তাবারুল হক
০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সাবেক তিন গভর্নরের তথ্য দেওয়া হচ্ছে না দুদককে

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর আতিউর রহমান, ফজলে কবির, আব্দুর রউফ তালুকদার এবং ভারতীয় দুই নাগরিকসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম, ঋণখেলাপিদের ছাড় দিয়ে নীতিমালা জারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, হলমার্ক জালিয়াতি, এস আলম গ্রুপ এবং বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে ১৫ বছর ব্যাংক খাতকে ধ্বংস করার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু অভিযোগ সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে একাধিকবার চিঠি দিয়েও যথাযথ তথ্য-উপাত্ত পাচ্ছে না দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। এ কারণে অনুসন্ধান কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দুদকের উপ-পরিচালক মোমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম এ অনুসন্ধান করছে। টিমের অপর দুই সদস্য হলেন উপপরিচালক রণজিৎ কুমার কর্মকার এবং উপসহকারী পরিচালক ইয়াছিন মোল্লা।

অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, অভিযোগটি গত জুনে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। এরপরই অনুসন্ধান টিম অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এবং অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে নথিপত্র চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর চিঠি পাঠায়। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না আসায় সম্প্রতি ফের চিঠি পাঠিয়েছে অনুসন্ধান টিম।

অভিযোগ সংশ্লিষ্ট অন্যরা হলেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী, এস এম মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান, আহমেদ জামাল ও আবু ফারাহ মো. নাসের, বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস ও কাজী সায়েদুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক দেবদুলাল রায় ও মেজবাউল হক, পরিচালক তফাজ্জল হুসাইন, অতিরিক্ত পরিচালক মসিউজ্জামান খান ও মাসুম বিল্লাহ, উপ-পরিচালক মসিউজ্জামান। এ ছাড়া ভারতীয় দুই নাগরিক নীলা ভান্নান ও রাকেশ আস্তানা। গভর্নরের কাছে পাঠানো চিঠিতে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে।

গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাবেক গভর্নর আতিউরের বিরুদ্ধে জনতা ব্যাংকে অ্যাননটেক্সের ঋণ জালিয়াতি করে ২৯৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি মামলা করে দুদক। এতে তৎকালীন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল বারাকাতকেও আসামি করা হয়। পরবর্তী সময় এ মামলায় বারকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় ১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের দশম গভর্নর হিসেবে চার বছরের জন্য দায়িত্ব পান আতিউর রহমান। এরপর তাকে আরও এক মেয়াদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ দায়িত্বে রাখা হয়। ২০১৬ সালের ২ আগস্ট তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সমালোচনার মধ্যে সে বছরের মার্চে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

অনুসন্ধানের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দুদক যেসব তথ্য চেয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ২০০৯ সালের আগের খেলাপি ঋণ নিয়মিতকরণ সংক্রান্ত নীতিমালার সত্যায়িত ফটোকপি। ২০০৯ সালের পর থেকে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার জন্য জারি করা নীতিমালা। ২০০৯ সালের পর খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার নতুন নীতিমালা জারি হওয়ার পর থেকে এ নীতিমালার সুবিধাপ্রাপ্ত বেক্সিমকো গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, কেয়া গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, থার্মেক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, বিবিএস গ্রুপ, আব্দুল মোনেম গ্রুপ, অ্যাননটেক্স গ্রুপসহ যেসব গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ওই সুবিধা পেয়েছেন এবং নামে-বেনামে যেসব ঋণ গ্রহণ করেছেন তাদের ঋণ যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে সেগুলোর নাম ও শাখার নাম। আরও যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ একই সঙ্গে গ্রহণ করা ঋণের হিসাবের নাম, স্বত্বাধিকারীর নাম, প্রতিষ্ঠান এবং স্বত্বাধিকারীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানাসহ গ্রহণ করা ঋণের পরিমাণ, ঋণের বর্তমান অবস্থার তথ্য। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণের তালিকা। ২০০৯ সালের পর জারি করা ব্যাংক পরিদর্শন সংক্রান্ত নীতিমালার সত্যায়িত ফটোকপি এবং ওই নীতিমালা প্রণয়ন ও জারির নোটশিটসহ নথিপত্রের সত্যায়িত কপি। হলমার্ক ঋণ জালিয়াতি সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন এবং এ বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোর নোটশিটসহ নথি ও পরিপত্র। বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন এবং এ সংক্রান্ত পদক্ষেপের নোটশিট ও পরিপত্র।

আতিউরের সময় অনুমোদন পাওয়া ৯ ব্যাংকের (মেঘনা, মিডল্যান্ড, মধুমতি, এনআরবি, এনআরবি কমার্শিয়াল, এনআরবি গ্লোবাল, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার, ইউনিয়ন ও ফার্মাস ব্যাংক) অনুমোদন সংক্রান্ত নোটশিটের কপি এবং পরিপত্র বা প্রজ্ঞাপন সংক্রান্ত তথ্য। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের পত্রের প্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠন সংক্রান্ত নীতিমালা (২০১৫) প্রণয়নের নোটশিটসহ নথি ও পরিপত্র। রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য এবং অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনের সত্যায়িত কপি ও সর্বশেষ তথ্য। ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কেনা বা মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নোটশিটসহ পরিপত্রের সত্যায়িত কপি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অভ্যন্তরীণ তদন্ত হয়ে থাকলে সেটির প্রতিবেদনের সত্যায়িত কপি। সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের মেয়াদকালে জারিকৃত সব ঋণ নীতিমালার সত্যায়িত কপি। সুদের হার ৯ শতাংশ সম্পর্কিত সার্কুলার বা নীতিমালার সত্যায়িত কপি। খেলাপি ঋণমুক্ত থাকার পদ্ধতি চালু করার নীতিমালার সত্যায়িত কপি। এ ছাড়া তানভীর দোহার রিজার্ভ চুরিসংক্রান্ত অনুসন্ধানের কপিও চাওয়া হয়।

দুদক কর্মকর্তারা জানান, এর আগেও এসব তথ্য-উপাত্ত চেয়ে গভর্নর বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তারা নির্ধারিত সময়ের পরও সেগুলো সরবরাহ করেনি। এ কারণে ফের চিঠি পাঠানো হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ায় অনুসন্ধান কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। আমাদের প্রত্যাশা, এবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাদের চাওয়া অনুযায়ী তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে।

দুদকের এক কর্মকর্তা আরও বলেন, ১৫ বছর ধরে আর্থিক খাতে বিস্তর জালিয়াতি, অনিয়ম-দুর্নীতি করা হয়েছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হলে বর্তমানে যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বে আছেন তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। অন্যথা সম্ভব নয়। কিন্তু অনুসন্ধান টিম সে ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছে না। এ কারণে অনুসন্ধান দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।