নগদ ব্যবস্থাপনার খরচ কমাতে ডিজিটাল লেনদেনে জোর

জিয়াদুল ইসলাম
০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নগদ ব্যবস্থাপনার খরচ কমাতে ডিজিটাল লেনদেনে জোর

দেশকে ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নিতে নগদবিহীন (ডিজিটাল) লেনদেনের ওপর জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে নগদ টাকা ব্যবস্থাপনার খরচ কমাতে কিউআর কোডের ব্যবহার ও ক্যাশলেস লেনদেন বাড়াতে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ।

এরই অংশ হিসেবে ব্যবসার লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন লাইসেন্স পেতে কিউআর কোড গ্রহণের শর্তারোপ এবং বাজারভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে কিউআর কোড ব্যবহারের বিস্তার নিয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য ব্যাংক ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ক্যাশলেস ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার লক্ষ্যে দুই বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে নগদ লেনদেন এবং নগদ লেনদেন ব্যবস্থাপনায় কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, সেই তথ্যও যাচাই করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধির মাধ্যমে নগদ টাকার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা গেলে শুধু আর্থিক লেনদেন সহজ হবে না, বরং প্রতিবছর টাকা ছাপানো ও ব্যবস্থাপনার বিপুল খরচও কমবে। দেশের সব ব্যাংকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ব্যাংকার্স সভার কার্যবিরণী পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিউআর কোড ব্যবহারে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে। গ্রাহককে কিউআর কোড ব্যবহারে উৎসাহিত করার জন্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ এবং সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। এ জন্য দরকার ব্যাংক, এমএফএস ও ব্যবসায়ীদের সমন্বিত উদ্যোগ। এতে একদিকে যেমন ব্যবসায়ীরা নগদবিহীন লেনদেনে অভ্যস্ত হবে, অন্যদিকে গ্রাহকের আস্থাও বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান আমাদের সময়কে বলেন, দেশে কিউআর কোডের ব্যবহার এখনও সীমিত। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এটি ব্যবহারে অনীহা রয়েছে। কারণ নগদে লেনদেন করলে কর ফাঁকি দেওয়া যায়। এ সীমাবদ্ধতা কাটাতে ব্যবসার লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন লাইসেন্স নিতে কিউআর কোড গ্রহণের শর্তারোপ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে চিঠি পাঠানো হয়েছে স্থানীয় সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে। ইতোমধ্যে ইতিবাচক জবাবও মিলেছে। এ ছাড়া ব্যাংকার্স সভায় নেওয়া অন্য সিদ্ধান্তগুলোও বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের আওতায় ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের ৭৫ শতাংশ লেনদেন ডিজিটাল করার পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য একটি সর্বজনীন বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে দেশের সমস্ত ব্যাংককে ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচের (এনপিএসবি) সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। এর আওতায় সব ব্যাংক ও এমএফএস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সারা দেশে কিউআর কোডে পেমেন্টসহ অন্যান্য ডিজিটাল লেনদেনে সর্বসাধারণকে উদ্বুদ্ধকরণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কিউআর কোডের ব্যবহার শুরু হয়েছে, যদিও তা এখনও সীমিত। ফলে ডিজিটাল লেনদেন আশানুরূপ হচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় লেনদেনের সব ক্ষেত্রে কিউআর কোর্ডের ব্যবহার বাড়াতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যাতে ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধি পায়। বিষয়টি নিয়ে গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভায় বলা হয়, বিশ্বের অনেক দেশে কিউআর কোডে লেনদেন দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে এর ব্যবহার এখনও সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। খুচরা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ ভোক্তাদের কাছে এর বিস্তার ঘটাতে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ওই সভায় ওই সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগের পরিচালক নওশাদ মোস্তাফা বলেন, কিউআর কোড ব্যবহারে কিছু মৌলিক সীমাবদ্ধতা এখনও রয়েছে। বিশেষ করে মার্চেন্ট পর্যায়ে। গ্রাহকরা মার্চেন্টকে কিউআর কোডে পেমেন্ট করতে পারলেও মার্চেন্টরা যখন হোলসেলারদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে চান, তখন তারা কিউআর কোডে পেমেন্ট করতে পারছেন না। ফলে ব্যাংক থেকে নগদ তুলতে হচ্ছে, যা পুরো প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে তুলছে এবং কিউআর কোড ব্যবহার প্রসারে বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি বাজারভিত্তিক প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে হোলসেলারদের কিউআর কোড গ্রহণে উৎসাহিত করার প্রস্তাব দেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানান, ক্যাশলেস ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার লক্ষ্যে দুই বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ট্রেড লাইসেন্সের সঙ্গে কিউআর কোড গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা এবং বিভাগীয় শহরের নিউমার্কেটগুলোর দোকানগুলোতে পস মেশিন (পিওএস) স্থাপন ও কিউআর কোর্ড গ্রহণে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এ সময় গভর্নর বলেন, পরিসংখ্যানে কিউআর কোডে লেনদেন বৃদ্ধি পেলেও বাস্তবে এর ব্যবহার এখনও সীমিত রয়ে গেছে, যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি ব্যবসার লাইসেন্স নিতে বাধ্যতামূলকভাবে কিউআর কোড গ্রহণের শর্তারোপ, বাজারভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ব্যাংক ও এমএফএস প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব করেন, যারা কিউআর কোড ব্যবহারের বিস্তার নিয়ে সুপারিশ প্রণয়ন করবে। এ ছাড়া নগদ লেনদেন এবং নগদ লেনদেন ব্যবস্থাপনায় জাতীয় পর্যায়ে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে তা জানার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব তফসিলি ব্যাংকের ক্যাশ ম্যানেজমেন্টে বার্ষিক ব্যয়ের তথ্য একত্র করে একটি প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশ দেন গভর্নর।

এর পর গত মাসে ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ সামিট-২০২৫’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে গভর্নর আহসান এই মনসুর বলেন, নগদ টাকার ব্যবহার কমাতে ডিজিটাল লেনদেনে জোর দেওয়া হয়েছে। তার পরও প্রতিবছর ১০ শতাংশ করে নগদ টাকার লেনদেন বাড়ছে। এ চাহিদা মেটাতে গিয়ে টাকা ছাপানো, সংগ্রহ ও বিনষ্টে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।