এক খুনে তিন থানায় তিন মামলা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সেদিন দুপুরে দেশ ছেড়ে পালান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাজধানীসহ সারাদেশের রাস্তায় নেমে বিজয় উল্লাস শুরু করেন আপামর মানুষজন। সেদিন আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে আফতাবনগরের বাসা থেকে বেরিয়ে বাড্ডা এলাকায় যান এসি মেকানিক মো. আল আমিনও। কিন্তু বিধিবাম। দুপুরের পর থেকেই আন্দোলনকারী ও আনন্দ মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার সঙ্গে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় পুলিশের চলে দফায় দফায় সংঘর্ষ। এরপর রাতে আনন্দ মিছিল চলাকালে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালানোর চেষ্টা করে বাড্ডা থানার পুলিশ। এ সময় রাত পৌনে ১২টার দিকে মেরুল বাড্ডায় ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হন আল আমিন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং মারা যান।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম আল আমিনকে হারিয়ে একদিকে যখন অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে তার পরিবার, অন্যদিকে তখন অনৈতিক সুবিধা নিতে এই শহীদের লাশ নিয়ে মামলা বাণিজ্যের ফাঁদ পেতে বসে একাধিক চক্র। শহীদ আল আমিনের স্বজনদের অভিযোগ- চক্রের সদস্যরা আর্থিক অনুদান পাইয়ে দেওয়ার নাম করে তার পরিবারের কাছ থেকে মূল মৃত্যুসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, এমনকি তাকে সমাহিত করা বাড্ডা (বরকতপুর) কবরস্থানের সনদসহ সংশ্লিষ্ট সব নথিপত্র হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেয়। এরপর শহীদের পরিবারকে কিছু না জানিয়ে এসব সনদ ব্যবহার করে বাড্ডার পাশর্^বর্তী দুই থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩ শতাধিক মানুষের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা করে। ঘটনা বাড্ডা থানা এলাকায় হলেও ভুয়া দুটি মামলা করা হয় হাতিরঝিল ও ভাটারা থানায়। গত ২৭ অক্টোবর হাতিরঝিল থানায় ১৯৫ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা (নম্বর-২১) করেন চক্রের সদস্য মো. মোজারুল। আর গত ২১ ডিসেম্বর শহীদ আল আমিনের ভাইয়ের ছেলে পরিচয়ে ভাটারা থানায় ১৮৭ জনকে আসামি করে অন্য মামলাটি করেন জনৈক রহমান মাল।
ঘটনাটি জানাজানি হলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে গত ১৩ আগস্ট নিহতের বড় ভাই পারভেজ রাব্বী বাদী হয়ে শেখ হাসিনাসহ ১৯৬ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও অচেনা আরও ৩০০ জনের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা (নম্বর-১৮) করেন।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, হাতিরঝিল ও ভাটারা থানায় দায়ের করা মামলার দুই বাদীর কাউকেই চেনেন না তারা। আল আমিনের চিকিৎসা সনদপত্র দিয়ে মানুষকে নানা ধরনের হয়রানি করতে কিংবা আসামিদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অনৈতিক সুবিধা নিতে নিহতের পরিবারকে না জানিয়ে আল আমিনের মৃত্যুর সনদপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে মামলা করেছে চক্রটি।
এদিকে বাড্ডা থানায় শহীদ আল আমিনের ভাইয়ের দায়ের করা মামলায় ১৬ নম্বর আসামি করা হয়েছে রাজধানীর রামপুরা ২২নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি নিজাম উদ্দিন টিপু ওরফে মোবাইল টিপুকে। তার বিরুদ্ধে নিহত আল আমিনের চিকিৎসার সনদ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় মামলায়।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বিএনপি নেতা নিজাম উদ্দিন টিপু আমাদের সময়কে বলেন, আমি জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শুরু থেকেই মাঠে ছিলাম। শহীদ আল আমিন হত্যাকা-ে কোনো মামলার বিষয়েই আমি সম্পৃক্ত নই। এরপরও একজন শহীদের হত্যা মামলায় কেন আমাকে জড়ানো হলো তা বোধগম্য নয়। একটি মহল রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্যই আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। শহীদ আল আমিনের ভাইয়ের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন তিনি।
শহীদ আল আমিনের স্ত্রী সুমী আক্তার জানান, ঘটনার দিন দুপুরের খাবার খেয়ে বাসা থেকে বের হন আল আমিন। সন্ধ্যায় সুমীর সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় মোবাইল ফোনে। রাত ২টার দিকে অচেনা এক নম্বর থেকে ফোন করে একজন জানান, মেরুল বাড্ডার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আল আমিন; তিনি মুগদা হাসপাতালে আছেন। গভীর রাতে আল আমিনের বড় ভাই ও স্ত্রী হাসপাতালে গিয়ে তার লাশ শনাক্ত করেন।
নিহত আল আমিনের বড় ভাই মো. পারভেজ বলেন, আমার ভাইকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধারকারী ব্যক্তি আমাদের বলেন, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে থেকে গুলিবিদ্ধ আল আমিনকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন তিনি। ৫ আগস্ট রাতে বাড্ডা থানার পুলিশ গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। সেই গুলিতেই মারা গেছে আল আমিন। ভাইয়ের মৃত্যুর পর কয়েকজন আমাদের সাহায্য করার নাম করে তার মৃত্যুর সনদ, হাসপাতালের কাগজপত্র নিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের তারা কোনো ধরনের সহায়তার ব্যবস্থা করেনি। পরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় আল আমিনের নাম।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল বুধবার ভুয়া দুই মামলার বাদী মোজারুল ও রহমান মালের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বাড্ডা থানার এসআই সৈয়দ গোলাম মাওলা জানান, সব অভিযোগ সামনে রেখে শহীদ আল আমিন হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। তদন্তের পর এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ফৌজদারি মামলায় ভুক্তভোগী বা ভুক্তভোগীর পরিবারের কেউ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া অন্য কেউ এ মামলা করতে পারেন না। যদি কেউ ভুক্তভোগীর পরিবারকে না জানিয়ে মামলা করেন, তবে বুঝতে হবে- এর পেছনে ওই ব্যক্তির অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। ভুয়া মামলা করার কারণে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে মামলা করার সুযোগও আছে। হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে ভুক্তভোগীর পরিবার অথবা পুলিশ বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করতে পারে, বলেন তিনি।
গত মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় সারাদেশে অনেক নিরীহ মানুষের নামে মামলা হয়েছে। অনেকে মামলা বাণিজ্যও করেছেন। অনেক মামলায় নিরীহ মানুষদের ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আসামি করা হয়েছে। এ জন্য সরকার ফৌজদারি কার্যবিধিতে ১৭৩ ধারাকে সংযোজিত করে ১৭৩-এর ‘এ’ নামে আরেকটি ধারা আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রণয়ন করেছে। এ ধারা অনুযায়ী যারা নিজেকে নির্দোষ-নিরীহ মনে করেন, তারা সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের মাধ্যমে নির্দোষ হিসেবে আদালতে প্রতিবেদন পাঠাতে পারেন। আদালত সেটি গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন।
হয়রানির মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে নতুন নিয়মে আবেদনের কথা জানিয়ে আইজিপি বলেন, নতুন নিয়মে এখন পর্যন্ত ১৩৬ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং আরও ২৩৬ জনের আবেদন বিবেচনাধীন রয়েছে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন