ফেঁসে যাচ্ছেন ফ্ল্যাট পাওয়া ১২ সাবেক সচিব ও বিচারক
নীতিমালা ভেঙে রাজধানীর ধানমন্ডিতে সরকারি ভবনে ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়ার ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন সাবেক ১২ জন সচিব ও বিচারক। তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অভিযোগ রয়েছে, ধানমন্ডি-৬ এর প্লট নম্বর ৬৩ মূলত সরকারি খাসজমি, যার বাজারমূল্য অত্যন্ত বেশি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে জমিটি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং সেখানে ১৪ তলার একটি ভবন নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভবনটিতে রয়েছে দুটি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট ও নিচতলাসহ দোতলা পার্কিং লট। ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট দুটি বরাদ্দ দেওয়া হয় দুদকের সাবেক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান ও জহরুল হকের নামে। বাকি ১০টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ পান অন্য সাবেক সচিব ও কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুদকের সাবেক দুই কমিশনার একটি করে ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করেছিলেন, কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে তারা বাগিয়ে নিয়েছেন ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট। যদিও গৃহায়ন ও গণপূর্তের ওই প্রকল্পের পরিকল্পনা ও নীতিমালায় কোনো ধরনের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের উল্লেখ নেই। দুই কমিশনার একটির জায়গায় দুটি করে ফ্ল্যাট বাগিয়ে নিয়েছেন। পরে ওই দুটি ফ্ল্যাটকে ডুপ্লেক্স ঘোষণা করা হয় এবং তা ডুপ্লেক্স হিসেবেই নির্মাণ করা হচ্ছিল। দুদকের অনুসন্ধানে এর প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘রাতের ভোটের পুরস্কার’ হিসেবে সাবেক এই ১২ কর্মকর্তা ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন। তারা হলেন- দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মো. জহুরুল হক, সাবেক সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান, সাবেক সিনিয়র সচিব ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান, সাবেক সচিব এমএ কাদের সরকার, সাবেক সিনিয়র সচিব এম আসলাম আলম, সাবেক সচিব আকতারী মমতাজ, সাবেক সচিব মো. সিরাজুল হক খান, সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ, সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সাবেক সিনিয়র জেলা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ, সাবেক সিনিয়র সচিব ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান এবং সাবেক সিনিয়র সচিব এসএম গোলাম ফারুক।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
দুদক থেকে জানা গেছে, অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর প্রকাশ্য অনুসন্ধান করছেন দুদকের সহকারী পরিচালক আল আমিন। সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করে প্রথম দফায় সেগুলো যাচাই-বছাই করা হয়েছে। এরপর অভিযুক্তদের বক্তব্য জানতে গত ১৭, ১৮ ও ২১ সেপ্টেম্বর তলব করেছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
অভিযুক্ত কয়েকজন দুদকে হাজির হয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তার মুখোমুখি হন। কেউ কেউ লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছেন। কেউ হাজির হননি, এমনকি লিখিত বক্তব্যও দেননি। দুদকের সাবেক দুই কমিশনারের কেউই হাজির হননি। জহুরুল হক লিখিত বক্তব্য পাঠিয়ে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট বরাদ্দ নেওয়া সম্পর্কে অনিয়ম-দুর্নীতি করেননি বলে দাবি করেছেন। মোজাম্মেল হক খান উপস্থিত হননি, এমনকি লিখিত বক্তব্যও পাঠাননি।
অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, তৎকালীন সরকারের সুদৃষ্টির কারণে ‘রাতের ভোটের পুরস্কার’ হিসেবে তারা ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সেটা আসলে পুরোপুরি সত্য নয়। এই ১২ জনের মধ্যে কেউ কেউ নির্বাচনের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে কখনও সম্পৃক্ত ছিলেন না। আবার কেউ কেউ ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেই অবসরে যান। তবে তারা সবাই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যে কারণে সরকারি চাকরি শেষে পরবর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে জহুরুল হক ও মোজাম্মেল হক খানসহ অভিযুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কল দিয়েও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।
জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, অভিযুক্তদের বক্তব্য নেওয়ার জন্য তলব করা হয়েছিল। কেউ কেউ এসেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন, কেউ আবার লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছেন। এখন অনুসন্ধান কর্মকর্তা সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আইনানুগ পদক্ষেপের জন্য সুপারিশ করবেন। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে কমিশন।
দুদকের আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তা গুছিয়ে আনা হয়েছে। ফ্ল্যাট বরাদ্দে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ বিষয়টি হয়তো মামলার দিকে যেতে পারে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বলছে, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ‘গৃহায়ন ধানমন্ডি (১ম পর্যায়)’ প্রকল্পের আওতায় অনৈতিকভাবে উচ্চমূল্যের ফ্ল্যাট বরাদ্দের অভিযোগ অনুসন্ধানে অভিযান চালানো হয়। ওই প্রকল্পে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ১৩ নম্বর (নতুন ৬/এ) সড়কের ৭১১ নম্বর (নতুন ৬৩) বাড়িতে ১৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ৬০ শতাংশ (১২টি) সরকারি ও ৪০ শতাংশ (৬টি) বেসরকারি কোটায় বরাদ্দযোগ্য ছিল।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ গঠিত একটি তদন্ত কমিটির সুপারিশ আমলে নিয়ে গত ৮ জুলাই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এসব বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বরাদ্দ বাতিল করে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন