বাজার বৈচিত্র্যে রপ্তানি বাড়াবে সরকার

আবু আলী
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বাজার বৈচিত্র্যে রপ্তানি বাড়াবে সরকার

রপ্তানি বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রপ্তানি নীতি প্রণয়ন, সরকারের সহায়তায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণ, আংশিক রপ্তানিকারক শিল্পে ব্যাংক গ্যারান্টির বিপরীতে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে বড় ধরনের কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে শুধু তৈরি পোশাকনির্ভর খাতকে নতুন বাজার ও নতুন খাতে প্রসারিত করতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আটটি সম্ভাবনাময় খাতের রপ্তানিকারকদের ৪৬টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আয়োজন করা হবে আন্তর্জাতিক মানের ‘গ্লোবাল সোর্সিং এক্সপো’, যা বাংলাদেশে বৈশ্বিক ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় নির্ভর করছে দুটি প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওপর। বিশেষ করে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত মোট রপ্তানির প্রায় ৮৩ শতাংশ দখল করে আছে। যদিও পোশাক খাত বাংলাদেশের সাফল্যের মূল চালক, তবে একই সঙ্গে এটি দেশের জন্য একটি ঝুঁকিও বয়ে আনছে। বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমে গেলে বা বাণিজ্যনীতিতে পরিবর্তন এলে সামগ্রিক রপ্তানি আয়ে ধাক্কা লাগতে পারে।

এমন প্রেক্ষাপটে সরকার নতুন বাজার যেমন পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে লক্ষ্য করে রপ্তানি বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে। একই সঙ্গে অপ্রচলিত খাত যেমন কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, চামড়া, ওষুধ, আসবাবপত্র, হস্তশিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পুরো উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)।

ইপিবি জানিয়েছে, এবার ৪৬টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এসব মেলায় রপ্তানিকারকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণ ফি ভর্তুকি দেবে সরকার। বড় রপ্তানিকারকরা পাবেন ৩০ শতাংশ, মাঝারি প্রতিষ্ঠান ৪০ শতাংশ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা (এসএমই) ৫০ শতাংশ এবং নারী উদ্যোক্তারা সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ সহায়তা পাবেন। এতে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে।

অন্যদিকে আগামী ১-৩ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে গ্লোবাল সোর্সিং এক্সপো ‘সোর্সিং বাংলাদেশ’। এটি হবে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের সোর্সিং মেলা, যেখানে অগ্রাধিকার খাতের প্রায় দুইশর বেশি রপ্তানিকারক অংশ নেবেন। মেলায় অন্তত ৫০ জন শীর্ষ আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও ব্র্যান্ড প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের জন্য বিশেষ আতিথেয়তা প্যাকেজ দেওয়া হবে। মেলায় থাকবে বি-টু-বি ম্যাচমেকিং সেশন, সেমিনার, নেটওয়ার্কিং প্রোগ্রাম ও পণ্যের প্রদর্শনী।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, অপ্রচলিত বাজারে অংশীদারত্ব বাড়ছে। এ কর্মসূচি আরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর শুল্ক সুবিধা হারানোর বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ জন্য প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে দ্রুত বাণিজ্য চুক্তি করা জরুরি। তিনি বলেন, জাপান একটি সম্ভাবনাময় বাজার। বর্তমানে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (ইপিএ) নিয়ে আলোচনা চলছে। এ চুক্তি হলে রপ্তানি আরও বৃদ্ধি পাবে।

আংশিক রপ্তনিকারকদের শুল্কমুক্ত আমদানির সুবিধা

রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আংশিক রপ্তানিকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংক গ্যারান্টির বিপরীতে কাঁচামাল শুল্কমুক্তভাবে আমদানির সুযোগ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

এনবিআর জানায়, বিদ্যমান বন্ড ব্যবস্থার শর্ত পূরণ করতে না পারা রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও এ প্রজ্ঞাপনের আওতায় কাঁচামাল আমদানি করতে পারবে। শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে আমদানীকৃত পণ্যের ওপর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত শুল্ক ও করের সমপরিমাণ ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দিতে হবে।

সংস্থাটি আশা করছে, এ উদ্যোগের ফলে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে। একই সঙ্গে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের সামগ্রিক রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় ধরনের স্বস্তির বার্তা। কারণ, বন্ড লাইসেন্স প্রাপ্তি ও ব্যবস্থাপনা অনেক সময় জটিল এবং ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে, যা এ সুবিধার মাধ্যমে অনেকটাই লাঘব হবে।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ১৫ বছর ধরে আমরা বলে আসছি পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। নতুন নতুন বাজারের খোঁজ করতে হবে। পোশাকের বাইরে পণ্য খাত বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, রপ্তানি বাড়ানোয় সংরক্ষণমূলক শুল্ক কাঠামো বাধা হিসেবে কাজ করছে। রপ্তানি আয় আরও বাড়াতে হলে পণ্য বহুমুখী করা ও শুল্ক কাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। তিনি বলেন, আমাদের শুল্ক ও কাস্টমস প্রক্রিয়াগুলো সহজ করা উচিত এবং বাজারে পৌঁছানোর সময় কমাতে হবে। পোশাকের বাইরে রপ্তানিযোগ্য পণ্য যেমন হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, ইলেকট্রনিকস ও আইটি সেবায় বিনিয়োগ করতে হবে। বাণিজ্য কূটনীতি শক্তিশালী করতে হবে যেন এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার উদীয়মান বাজারের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করা বা শুল্ক বাধা কমানো যায়।