আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে

জিয়াদুল ইসলাম
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে

দেশের নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত (্এনবিএফআই) ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। উচ্চ খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি ও আমানত প্রবাহে ভাটা- এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকাকে কঠিন করে তুলেছে। বিশেষ করে নানা সংকটে পড়ে ২০টির মতো প্রতিষ্ঠান দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাতেও হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। মূলত অনিয়ম, লুটপাট আর অব্যবস্থাপনায় চরম সংকটে পড়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একাধিকবার বিশেষ ছাড় ও ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়ার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা ৯টি প্রতিষ্ঠানকে এক মাস আগে অবসায়নের (লিকুইডেশন) সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও সেই প্রক্রিয়া খুব এগোয়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল তদারকি এবং পরিকল্পিত লুটপাটের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে নেমেছে। এর প্রভাবে আমানত প্রবাহে ভাটা পড়েছে। আবার আগের ঋণ ফেরত আসছে না। এতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকট। তাই খাতটিকে টিকিয়ে রাখতে দ্রুত বড় ধরনের সংস্কার দরকার। সেই সঙ্গে লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা এবং ঋণ পুনরুদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের বর্তমান দুরবস্থার জন্য বহুল আলোচিত পি কে হালদারের অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারিকে দায়ী করে আসছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১৪ সালের দিকে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বসে অন্তত চারটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ বের করেন।

এর বাইরে দুর্বল হয়ে পড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালক ও তাদের ঘনিষ্ঠরা ঋণের নামে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই ঋণের সবটাই এখন খেলাপির খাতায় উঠেছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে উদ্দেশ্যে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য তারা পুরণ করতে পারেনি। উল্টো তারা ব্যাংকের মতোই কার্যক্রম চালাচ্ছে। আবার ব্যাংকের মতো এ খাতেও বিপুল অর্থ তছরুপ হয়েছে। তাই অনিয়মে জড়িত ও অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো মানে নেই। তবে সবকিছু করতে হবে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করে।

জানা গেছে, বিগত সময়ে পুনঃতফসিল আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এ খাতেও খেলাপির প্রকৃত চিত্র আড়াল করে রাখা হয়েছিল। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারিতে চেপে রাখা খেলাপি ঋণ এখন প্রকাশ পাচ্ছে। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি গ্রাহক আস্থা মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যেই ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার খবর সামনে আসায় এ খাতে আমানত তোলার চাপ বেড়ে গেছে। এতে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমছে। আবার যেসব ঋণ দেওয়া হচ্ছে, তার বড় অংশ ফেরত আসছে না। এই দুষ্টচক্রের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান গুনতে বাধ্য হচ্ছে। এর প্রভাব পুরো আর্থিক খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) সাবেক চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন তদারকির বাইরে ছিল। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান খারাপ হয়ে গেছে। এখন একীভূত বা মূলধন জোগান দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করতে হবে। পাশাপাশি সঠিক বিধিবিধান দিয়ে খাতটিকে এগিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমানত প্রবাহে ভাটা : আস্থা সংকটে আমানত টানতে ব্যর্থ হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। বিশেষ করে দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ব্যক্তি আমানতকারী টাকা তুলে নিচ্ছেন। ফলে সার্বিকভাবে এ খাতে আমানত বাড়লেও ব্যক্তি আমানত কমে যাচ্ছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে এ খাতে সার্বিক আমানত বেড়েছে মাত্র ২৮৬ কোটি টাকা। একই সময়ে পুরুষ ব্যক্তি আমানত কমেছে ৭৭৩ কোটি টাকা। আগের তিন মাসে সার্বিক আমানত ১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা বৃদ্ধির বিপরীতে পুরুষ ও নারী মিলে ব্যক্তি আমানত কমেছিল প্রায় ৬৫৭ কোটি টাকা।

বাড়ছে খেলাপি ঋণ : চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন- এই ছয় মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২৭ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৭৯ কোটি টাকা বা ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর মধ্যে ২০টির মতো প্রতিষ্ঠানে খেলাপির হার দাঁড়িয়েছে ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশে, যা কার্যত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়া হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

লোকসানে হাবুডুবু খাচ্ছে : উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের লোকসান দিন দিন বাড়ছে। গত বছর সার্বিক খাতে লোকসান হয় ৩ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। এই নিয়ে টানা ছয় বছর ধরে লোকসানের রয়েছে খাতটি। ২০২৩ সালে লোকসানের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে লোকসান বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এদিকে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেও এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পড়েছে। এরই মধ্যে দেশে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৬টি তাদের অর্ধবার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, ১০টি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত লোকসান দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা।

৯টি বন্ধের সিদ্ধান্ত, ঝুঁকিতে আরও ১১টি : দেশে বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে ২২টি দেশীয় মালিকানাধীন। ১৩টি দেশি ও বিদেশি যৌথ মালিকানাধীন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও টাকা ফেরত দিতে না পারা ২০টি প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ করা হবে না- জানতে চেয়ে গত মাসে নোটিশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানের ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সন্তোষজনক না হওয়ায় তাদের বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের পক্ষ থেকেও এতে সায় এসেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আভিভা ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স ও প্রাইম ফাইন্যান্স। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৮০ শতাংশ থেকে ৯৯ শতাংশের ঘরে রয়েছে। বাকি ১১টি প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এগুলো হলো সিভিসি ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, হাজ ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, উত্তরা ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ও ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের ওপরে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মো. শাহরিয়ার সিদ্দিকী আমাদের সময়কে বলেন, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এটা এখনও পর্যালোচনা পর্যায়ে রয়েছে। সরকার থেকে টাকা পাওয়ার পর প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। তবে যা কিছু হবে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করেই হবে।