উৎসব হোক সম্প্রীতির সেতুবন্ধ
কবিতা নৃত্য গানে শরৎ উৎসব
সংস্কৃতির রুগ্নতা কাটাতে উৎসব হোক সম্প্রীতির সেতুবন্ধ- এমন প্রত্যাশার সুরে মুখর হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় আয়োজিত শরৎ উৎসব-১৪৩২। গতকাল শুক্রবার বিকালে ‘ষড়ঋতু উদ্যাপন জাতীয় পর্ষদ’র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এ উৎসব রূপ নেয় কবিতা, গান, নৃত্য ও কথামালার এক প্রাণময় মহামিলনে। সভাপতিত্ব করেন ষড়ঋতু উদ্যাপন জাতীয় পর্ষদের আহ্বায়ক এহ্সান মাহমুদ।
উদ্বোধনী বক্তৃতায় এহ্সান মাহমুদ বলেন, শরৎকে আমরা ক্যালেন্ডারের নির্দিষ্ট দিন ধরে উদ্যাপন করছি না; প্রকৃত শরৎ এসেছে আগেই। নানা কারণে আমরা তা বরণ করতে পারিনি। কিন্তু ফুল ফোটা বন্ধ হয়নি, শরতের আকাশও নীল আছে। দৈনিক আমাদের সময়ের নির্বাহী সম্পাদক বলেন, আমরা একসময় সম্প্রীতির বাংলাদেশের কথা বলতাম, এখন সেই চিত্রে যেন ছেদ পড়েছে। ভিন্ন রুচি, ভিন্ন পোশাক, চুল রাখার ধরন কিংবা খাদ্যাভ্যাসের কারণে কারও ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ হবে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলনের ঠিকানা।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্যে দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক, মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক আবু সাঈদ খান বলেন, বর্ষা কিংবা বসন্ত নিয়ে অনেক বিদ্রোহ হয়েছে, কিন্তু শরৎ নিয়ে কোনো দ্রোহ নেই। এমনকি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলও শরতের কাছে এসে শান্ত হয়েছেন। নগরায়ণের কারণে আমরা প্রকৃতি থেকে দূরে যাচ্ছি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে শরৎকালেই রবীন্দ্রনাথ রাখিবন্ধন উৎসব করেছিলেন। আজ সেই রাখিবন্ধন দরকার। তিনি বলেন, এই দেশ গড়ার জন্য আমরা ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ এবং সর্বশেষ ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পার করেছি। কবিতা, গান, আবৃত্তি ও শিল্পের মাধ্যমে আমাদের সংহতি আরও সুদৃঢ় করতে হবে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, শরৎ একটি কোমল ও মিষ্টি ঋতু, যেখানে গ্রীষ্ম বা শীতের চরমতা নেই। যাদের মনের কোমলতা কম, তাদের পক্ষে শরতের সৌন্দর্য উপলব্ধি করা কঠিন। কাশফুলের নরমতা, নীল আকাশ, মেঘ, চাঁদ ও তারা সবচেয়ে সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে এই ঋতুতে।
সব দেশে এই রূপ নেই, আমাদের দেশেই প্রকৃতি এভাবে ধরা দেয়। দেশের জটিলতার মধ্যেও প্রকৃতি আমাদের সম্ভার। আশ্বিন ও কার্তিক মাসে শরতের আবহ সবচেয়ে সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়। আমি বিশ্বাস করি, নাগরিক পরিসরেই প্রকৃতির আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব। আমাদের কবিতা, গান ও নৃত্যের মাধ্যমেই প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
লেখক, কবি ও পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, সংস্কৃতিকে প্রায়ই দুর্বোধ্য করে তোলা হয়। অথচ আমরা যা করি, যা বলি, যা চলি- তাই তো সংস্কৃতি। কিন্তু ফ্যাসিবাদের সময়ে সংস্কৃতিকে কৃত্রিমভাবে উচ্চমার্গীয় করে তোলা হয়েছিল। গত ১৫ বছরে বড় কোনো সাহিত্য, কাব্য, নাটক বা চলচ্চিত্র সৃষ্টি হয়নি। তবে আজ আমরা রুগ্নদশা থেকে বেরিয়ে আসছি। সংস্কৃতি চর্চার দুর্বলতা এখনও আছে, কিন্তু এটিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। আমরা পুনরুজ্জীবনের পথে হাঁটছি।
পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, সংস্কৃতির বিষয়টাকেও আমাদের কাছে অনেক সময় একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার হিসেবে হাজির করা হয়।
অথচ আমরা যা করি, যা চলি, যা বলি- তাই তো সংস্কৃতি। কিন্তু আমরা দেখেছি, ফ্যাসিবাদের আমলে এখানে একটা উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতির মতো করে একটা জিনিসের চর্চা হতো। আমাদের দেশেও এই ১৫ বছরে আমরা অনেক বড় বড় উৎসব, বড় বড় প্রকল্প সংস্কৃতির নামে হতে দেখেছি। কিন্তু কার্যত এই ১৫ বছরে আমরা এমন কোনো বড় সাহিত্য পাইনি, পাইনি বড় কাব্য, বড় নাটক কিংবা চলচ্চিত্র। সংস্কৃতির নামে তারা বড়াই করত।
আজকে আমরা রুগ্নদশা থেকে আবার মানুষের স্বাধীনতা ও আকাক্সক্ষার নতুন যাত্রা শুরু করেছি। ফলে দীর্ঘ রোগভোগের পর হঠাৎ করে শক্তিমান হয়ে ওঠা যায় না। আজকেও সংস্কৃতি চর্চার একটা দুর্বল অবস্থা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা এটাকে নেতিবাচকভাবে নয়, ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই। কারণ, আমরা এই রুগ্নতা থেকে বেরিয়ে আসা শুরু করেছি বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
জাতীয় কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক কবি লতিফুল ইসলাম শিবলি বলেন, শরৎ শুধু একটি ঋতু নয়, এটি শান্তি ও সহমর্মিতার প্রতীক। কবি নজরুলের সংগীত, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কিংবা জসীম উদ্দীনের কবিতায় শরতের আবহ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এমন উৎসব আমাদের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন লেখক ও প্রকাশক সাঈদ বারী, কবি ও সংগঠক মোহাম্মদ রোমেল, কবি মৃদুল মাহবুব প্রমুখ।
কবিতা পাঠ, গান, নৃত্য, আবৃত্তি আর শিল্পীর তুলিতে শরতের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে চারুকলার বকুলতলায়। বক্তাদের বক্তব্য যেমন বৈষম্যহীন, সম্প্রীতিময় বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় প্রকাশ করে, তেমনি সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ফুটে ওঠে শরতের নির্মল সৌন্দর্য।
উপস্থিত বক্তা ও শিল্পীরা একমত হন- শরৎ উৎসব শুধু একটি ঋতুর উদ্যাপন নয়; এটি সংস্কৃতির রুগ্নতা কাটিয়ে সম্প্রীতির নতুন সেতুবন্ধন গড়ার অঙ্গীকার।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম