চালের দাম বাড়ে লাফিয়ে কমে গড়িয়ে গড়িয়ে

রেজাউল রেজা
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
চালের দাম বাড়ে লাফিয়ে কমে গড়িয়ে গড়িয়ে

দীর্ঘ সময় ধরে চালের উচ্চমূল্যে ধরাশায়ী ভোক্তারা। চালের বড় মৌসুম বোরোতে রেকর্ড উৎপাদনের পরও কাক্সিক্ষত স্বস্তি ফেরেনি। বাধ্য হয়ে আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। তাতে বাজারে তেমন একটা প্রভাব পড়েনি। এখনও চড়া দামেই কিনে খেতে হচ্ছে চাল। নিম্ন ও খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে বাড়তি এ খরচ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ভোক্তাদের অভিযোগ, অযৌক্তিকভাবে হুটহাট চালের দাম লাফিয়ে বাড়ে। কিন্তু কমার সময় সেভাবে কমে না। এতে চালের পেছনে খরচ লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে।

কদমতলী এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সাইফুল ইসলাম বলেন, নতুন চাল ওঠার আগে হঠাৎ মিনিকেটের দাম বেড়ে আকাশচুম্বী। এরপর কিছুটা কমে আবার বেড়ে গেল। ভরা মৌসুমেও বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। আগে যে মিনিকেট ৭২ টাকা কেজি কিনেছি, মাঝে তা ৮৮ টাকা, এরপর ৮০ টাকা; এখন তা আবার ৭৮ টাকায় কিনে খাচ্ছি। কেজিপ্রতি ৬ টাকা খরচ বেড়ে গেল। অথচ খবরে জেনেছি, এবার বোরোতে রেকর্ড চাল উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু বাজারে দামে তার সুফল পাচ্ছি না।

রাজধানীর খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের বাজারে এখন কিছুই নিয়ম মেনে চলছে না। একেক সময় একেক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কারওয়ানবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। এ সময় দাম কমে ক্রেতাদের নাগালে চলে আসার কথা। অথচ, এখনও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বড় মিল ও করপোরেট কোম্পানিগুলো যেভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, সেভাবেই চলছে।

বাজার বিশ্লেষকরাও বলছেন, চালের বাজারে আগের মতোই অনিয়ম চলছে। ফলে মৌসুমেও অতিরিক্ত দামে কিনে খেতে হচ্ছে ভোক্তাদের। অথচ কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন না। এর মধ্য দিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা ফায়দা লুটছেন। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার্স

অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, এবার বোরো মৌসুমে যে পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে তাতে সরু চালের কেজি ৬২-৬৪ টাকা হওয়ার কথা। সেখানে এখনও ৮০ টাকার আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি ও দ্ররিদ্রের মোটা চালের দামও বাড়াত। মূলত, আমাদের ধান-চালের বাজারে মনিটরিংয়ের বড় ঘাটতি রয়েছে। আগের মতোই সবকিছু চলছে। বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত ধান-চাল সংগ্রহ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। আবার যারা আমদানি করছে, তারাও এসবের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং তাতেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা দেখি দাম বাড়ার সময় এক লাফে অনেকখানি বেড়ে যায় কিন্তু কমার সময় সেভাবে কমে না। এতে ভোক্তার খরচ বেড়েই চলছে। ভোক্তাস্বার্থে চালে এই চালবাজি বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় পর্যায় থেকে আমদানি ও সরবরাহ প্রতিটি ধাপে নজরদারি বাড়াতে হবে এবং প্রশাসনকে আরও শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের চেয়ে বর্তমানে সরু চালের দাম ১১ দশমিক ১১ শতাংশ, মাঝারি চালের দাম ১৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি রয়েছে। অথচ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এ বছর বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। এবার বোরো ধান রেকর্ড ২ কোটি ২৬ লাখ টন উৎপাদন হয়েছে, গত বছরের তুলনায় যা ১৬ লাখ টন বেশি। গত বোরোতে উৎপাদন ছিল ২ কোটি ১০ লাখ টন। এবার রেকর্ড উৎপাদনের পরও কৃষক ও ভোক্তা কেউ লাভবান হতে পারেনি।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার শাহাপুর গ্রামের ধানচাষি আব্দুল মান্নান বলেন, ধান উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেছে। পানি, সার ও শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে যা খরচ, তাতে ধান বিক্রি করে পোষায় না। কাজল লতা ধান এবার বিক্রি হয়েছে ১৩শ টাকা মণ, পায়জাম ১৫শ টাকা মণ, বাসমতি ১৬০০ টাকা মণ, স্বর্ণলতা ১৩৫০ টাকা, ২৮ ধান ১৪শ আর হাইব্রিড মোটা ধান বিক্রি হয়েছে ১১৫০ টাকা মণ। ধান উঠার সঙ্গে সঙ্গে মিল মালিকদের ফড়িয়ারা ধান কিনে নিয়ে যায়। আমরা ধানের দাম তেমন পাই না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের মোট চালের সিংহভাগই এই বোরো মৌসুমে উৎপাদিত হয়। অন্যান্য বছর এমন সময় বাজারে চালের; বিশেষ করে সরু চালের সরবরাহ বাড়লে খুচরায় দাম কমে। কিন্তু এ বছর দাম সেভাবে কমেনি। মিল মালিকদের অনেকে জানান, চালের মতো ধানের বাজারেও সিন্ডিকেট চক্র তৈরি হয়েছে। যাদের ব্যবসার কাগজপত্রও নেই। তারাই শুরুর দিকে ধানের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে। যার প্রভাব চালের বাজারের পড়েছে।

রাজধানীর খুচরা বিক্রেতারা জানান, ৭২-৭৪ টাকা কেজি মিনিকেটের দাম লাফিয়ে বেড়ে ৮৮ টাকা হওয়ার পর তা কমে ৮০ টাকা হয়। বোরোর নতুন চাল বাজারে উঠার পর মে মাসে তা কমে দাঁড়ায় ৭৬ টাকা কেজি। এরপর তা কমার বদলে আবার বেড়ে ৮০ টাকায় পৌঁছায়। এখন চাল আমদানি হওয়ায় দাম কিছুটা কমতির দিকে। তারও সামান্য পরিমাণে। মিনিকেটের কেজি এখন ৭৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যাল চাল ব্যবসায়ী মেসার্স মা ট্রেডার্সের মালিক মনজুরুল হক বলেন, মিনিকেট চাল বলে সরু চালের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আমরা অর্ডার দিয়েও মিল গেট থেকে চাল কিনতে পারছি না। ধানের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে চালকল মালিক লিয়াকত আলী জানান, ধানের দাম বৃদ্ধি ও ধান সংকটের কারণে মিনিকেট চালসহ সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। বাজারে পর্যাপ্ত ধান পাওয়া যাচ্ছে না। খাজানগর মোকামে ধান ও চালের মজুদ খুবই কম। মিনিকেট চাল স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে না। এ জন্য চাহিদার তুলনায় চালের সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে অর্ডার নিয়েও চাল সরবরাহ করতে পারছেন না সিংহভাগ মিলমালিক।

এদিকে নওগাঁ জেলায় এখন চালের বাজার নিম্নমুখী রয়েছে বলে দাবি করেছেন সেখানকার মিল মালিকরা। তাদের আমদানির প্রভাবে এমনটা হয়েছে। কিন্তু আমদানির এই ধারা অব্যাহত থাকার কারনে ইরি বোরো মৌসুমে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোপা আমন মৌসুমি কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

নওগাঁ জেলা অটোমেটিক রাইস মিল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম বাবু মুঠোফোনে জানান, সংকটকালীন সময়ে চাল আমদানি করলে সেটা বাজারে প্রভাব পড়ে না। কিন্তু দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ধান উৎপাদনের পরও ভারত থেকে চাল আমদানির কারণে নওগাঁর ব্যবসায়ী ও কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

নওগাঁ জেলা চাউল কল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার জানান, বর্তমানে বাজারে ধান চালের কোনো কেনাবেচা নেই। ধানের দাম স্থিতিশীল এবং চালের দাম নিম্নমুখী। ভরা মৌসুমে ভারত থেকে চাল আমদানি করার কারণে এমনটা হয়েছে।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আমাদের নওগাঁ প্রতিনিধি আসাদুর রহমান জয় ও কুষ্টিয়া প্রতিনিধি শামসুল আলম স্বপন।