রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণই প্রধান সমস্যা
দ্রুত সময়ের মধ্যে খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদ যেন কোনো পরিস্থিতিতেই ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। গত বুধবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠক করে এসব নির্দেশ দেন তিনি। বৈঠকে উঠে এসেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত এসব ব্যাংকের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ। খবর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রের।
জানা গেছে, খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। ব্যাংকগুলোর মূলধন পরিস্থিতি, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ, মুনাফা অর্জন, খেলাপি ঋণের অবস্থা, খেলাপি ঋণ আদায়ের অবস্থা, শীর্ষ ২০টি খেলাপির সাথে থাকা অর্থের পরিমাণ এবং তাদের কাছ থেকে এই ধরনের ঋণ আদায়, অবরুদ্ধ ঋণ থেকে আদায়, বিচারাধীন মামলার সংখ্যা, মামলার সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ, নিরীক্ষা আপত্তি এবং প্রভিশন ঘাটতি সম্পর্কে একটি উপস্থাপনা করা হয় বৈঠকে।
জানা গেছে, তিন মাসের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এর ৫৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা শীর্ষ ২০ খেলাপির দখলে।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, গত জুন শেষে সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (বিডিবিএল) আগের প্রন্তিকের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বেড়ে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকা, যা এসব ব্যাংকের বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় ৪৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক নিয়মে মোট ঋণের ৫ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি গ্রহণযোগ্য। গত মার্চ শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রতিটি ব্যাংকের ২০ শীর্ষ খেলাপি ঋণের পরিমাণও দেখানো হয়েছে। সে হিসাবে ছয় ব্যাংকে মোট ১২০ শীর্ষ খেলাপি, ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা এসব ব্যাংকের মোট খেলাপির প্রায় ৫৭ শতাংশ। বৈঠকে খেলাপি ঋণ আদায়ে বাড়তি মনোযোগ, বিশেষ করে শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে আদায় বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে সরকারের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস রয়েছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে দীর্ঘসূত্রতা ও আইনি জটিলতার ফাঁদে পড়া খেলাপি ঋণের অর্থ দ্রুত উদ্ধারে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে সমন হলে সংশ্লিষ্ট ঋণ খেলাপিকে গ্রেপ্তার করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
খেলাপি ঋণ আদায়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে। যদিও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি পরে বিবেচনা করা হবে বলে জানানো হয়। সূত্র মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল জনতা ব্যাংক। গত জুন শেষে এ ব্যাংকের মোট ঋণের ৭৬ শতাংশ খেলাপি। খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ১০৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৬৭ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার হার (ক্যাপিটল অ্যাডেকুয়েসি) ঋণাত্মক, ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। অথচ নিয়ম অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ বাফারসহ ন্যূনতম ১২ দশমিক ৫ শতাংশ থাকতে হবে।
সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তুলনামূলক কম। গত জুন শেষে ব্যাংকটির মোট ঋণের ২০ শতাংশ খেলাপি দেখা গেছে, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১৮ দশমিক ২০। অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো যেখানে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ, সেখানে সোনালী ব্যাংক সফল। জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ।
জুন শেষে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ। নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ হার (সিআরএআর) ১২ দশমিক ৫ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন রয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত অগ্রণীর মোট খেলাপি ঋণের ৪০ শতাংশই আটকে আছে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে।
জুন শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৪ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এ হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ। নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ হার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক হলেও রূপালী ব্যাংকের মূলধন মাত্র ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। একইভাবে বেসিক এবং বিডিবিএলের এসব সূচকে মারাত্মক অবনতি হয়েছে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন