গ্যাসের ঘাটতির ভেতরেই অপচয় ও চুরির হিড়িক
দেশে এক দশক ধরে গ্যাসের ঘাটতি প্রকট হলেও অপচয় ও চুরি থামানো যাচ্ছে না। তিতাসসহ বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস দিন দিন বেড়ে বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার গ্যাস হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দায়বদ্ধতা ও মনিটরিং জোরদার না করলে সংকট আরও গভীর হবে।
মোট চাহিদার অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ করতে পারে সরকার। এই অর্ধেক গ্যাস দিয়েই চলছে দেশের শিল্পকারখানা, আবাসিক গ্যাসের চাহিদা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সার কারখানা। গ্যাসের সংকট যখন চরমে, তখনও বিরাট অংশ অপচয় হয়ে যাচ্ছে। শত চেষ্টা করেও সেই অপচয়, চুরি অথবা অপব্যহার বন্ধ করতে পারছে না গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। প্রায় প্রতিদিন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে তবু গ্যাসের অপব্যবহার, অবৈধ ব্যবহার কমছে না। গত ৬ মাসের গ্যাসের ব্যবহারের পরিসংখ্যান দেখলেই দেখা যায়, অব্যাহতভাবে বেড়েছে গ্যাসের চুরি।
দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন। কোম্পানিটির গত ৬ মাসের গ্যাসের ব্যবহার পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্যাসের সিস্টেমলস ছিল ৯ দশমিক ২১ শতাংশ। ছয় মাস পর বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। খোদ তিতাসের হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, কেবল জুলাই মাসে প্রায় ১৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সিস্টেমলসের নামে চুরি বা অপচয় হয়েছে। এই গ্যাসের দাম যদি শিল্পে বিক্রীত গ্যাসের দামে ধরা হয়, তবে তা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সিস্টেমলস সর্বোচ্চ ২ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। বাকিটা চুরি হচ্ছে। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোতে গড়ে ১২ শতাংশ, অঞ্চলভেদে ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত সিস্টেমলস ও চুরি হচ্ছে।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ পারভেজ এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, তিতাস অব্যাহতভাবে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার সহায়তায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া গ্যাসের অপচয়রোধকল্পে আবাসিক গ্রাহকদের ৪ লাখ ২০ হাজার প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। দুটি প্রকল্পের আওতায় আরও সাড়ে ৬ লাখ এবং ১১ লাখ মিটার স্থাপনের কাজ চলছে। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহারের প্রবণতা অনেক বেশি। বিশেষ করে আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ হওয়ার পর থেকে নানা উপায়ে মানুষ ব্যবহার করছে। কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও এগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না।
তিতাসের একটি হিসাবে দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে তিতাসের নেটওয়ার্ক সিস্টেমে বা পাইপলাইনে গ্যাস ঢুকেছে ১ হাজার ২০৪ মিলিয়ন ঘনফুট, বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট। এ সময় সিস্টেমলস হয়েছে ১১১ মিলিয়ন ঘনফুট। সিস্টেমলস ছিল ৯ দশমিক ২১ শতাংশ। মার্চ, এপ্রিল, মে- তিন মাস গড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ সিস্টেমলস থাকলেও জুন ও জুলাইয়ে তা পর্যায়ক্রমে বেড়েছে। জুন মাসে ছিল প্রায় ১০ শতাংশ আর জুলাইয়ে ১২ শতাংশ।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
তিতাস সূত্রে জানা যায়, তিতাস তাদের কার্যক্রম কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা মেট্রো নর্থ অ্যান্ড সাউথ। জুলাই মাসে এ অঞ্চলে তিতাসের সিস্টেমলস গড়ে গত ছয় মাসে ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরে সিস্টেমলস দেখানো হয়েছে ১১ দশমিক ৬, নারায়ণগঞ্জে ১১ দশমিক ৩, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় প্রায় ২০ দশমিক ১, রূপগঞ্জের আড়াইহাজারে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি সিস্টেমলস যেসব এলাকায় হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ভৈরব। ভৈরবে সিস্টেমলস দেখানো হয়েছে ৩১ দশমিক ১৫, কিশোরগঞ্জে ২৬ দশমিক ৫৩, শেরপুরে ১৭ দশমিক ১২, নেত্রকোনায় ২১ দশমিক ৪০ এবং ময়মনসিংহে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ।
তিতাস বলছে, এত সিস্টেমলসের মূল কারণ অবৈধ গ্যাসের ব্যবহার। ননমিটার আবাসিক গ্রাহকের ক্ষেত্রে গ্যাসের ব্যবহার কম বিবেচনা করা হয়। তিতাস বলছে, ননমিটার আবাসিক গ্রাহকরা বেশি গ্যাস ব্যবহার করে। কিন্তু বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ডাবল বার্নার চুলা ৬০ ঘনমিটার এবং সিঙ্গেল ৫৫ ঘনমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, তা সিস্টেমলস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ ছাড়া গ্যাসের মিটারিং সিস্টেমের ভিন্নতাও দায়ী। ইনটেক পয়েন্টে ২৫টি মিটারের বিপরীতে তিতাসের গ্রাহক প্রান্তে প্রায় ১৩ হাজার মিটারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। ফলে হিসাবে ভিন্নতা তৈরি হচ্ছে।
সিস্টেমলস কমাতে অবৈধ গ্যাস উচ্ছেদ অভিযান জোরালো করা হয়েছে। তবে কোনো কাক্সিক্ষত ফল নেই। প্রিপেইড মিটার স্থাপন কার্যক্রম চললেও তা অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন গ্রাহকের রাইজার কিলিং বা স্থায়ী বিচ্ছিন্ন, জোনভিত্তিক নেটওয়ার্ক আইসোলেশন, মিটার পরীক্ষণ বা ক্যালিব্রেশন চলছে। তিতাস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৯৪৫টি সাধারণ অভিযান এবং ২৫৩টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৮৫ হাজার বার্নার বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
এ দিকে তিতাসের গত এক বছরের বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায়, ৩৯৪টি মোবাইল কোর্ট এবং ১ হাজার ৫২টি নিজস্ব অভিযান পরিচালনা করে ৩০২টি শিল্প, ৩৮২টি বাণিজ্যিক ও ৬১ হাজার ৪৫৯টি আবাসিক গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, যার বার্নারের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৩৫টি। উক্ত অভিযানে প্রায় ২৫৮ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন উচ্ছেদ করা হয়। এ ছাড়া তিতাস গ্যাসের মোট ১৪ জন কর্মকর্তা ও ১৬ জন কর্মচারীর অবৈধ গ্যাস ব্যবহারে সহযোগিতার দায়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অনিয়মের অপরাধে ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। দীর্ঘমেয়াদে সিস্টেম লস হ্রাসে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে তিতাসের আওতাধীন ৫২টি বিক্রয় জোনের ৩৬৫ জন কর্মকর্তাকে অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য (বিইআরসি) মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, সিস্টেম লস, গ্যাস চুরি এগুলো বন্ধ করতে সবচেয়ে বড় দরকার আন্তরিকতা। গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তাদের মধ্যে এর অভাব রয়েছে। প্রতিটি জোনভিত্তিক কর্মকর্তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনলেই সিস্টেমলস অনেক কমে যাবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, বিগত সময়গুলোয়ও গ্যাস খাতের দুর্নীতি বন্ধ করা যায়নি। এখনও পারছে না বরং আরও বেড়েছে। কেন গ্যাসের অব্যবহার, চুরি বন্ধ হচ্ছে না, নতুন করে কারও মধ্যে কোনো ভাবনা নেই। গতানুগতি বৈঠক আর পেপারওয়ার্ক করেই যাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের নীতি পলিসির পরিবর্তন করতে হবে। একই দেশে নানা ধরনের গ্যাসের ব্যবহার। এতে নানাভাবে মানুষকে অবৈধ গ্যাস সংযোগ ব্যবহারে উৎসাহিত করছে ।
পেট্রোবাংলার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, তিতাস সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। এ কোম্পানির কার্যদক্ষতা বাড়াতে সরকার তিতাসকে আলাদা তিনটি কোম্পানি করার চেষ্টা করেছিল। পরে তা তিনটি জোনে ভাগ করে তিনজন ডিএমডি বসানো হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। একটি আবাসিক গ্রাহকের ফাইলও এমডি পর্যন্ত আসতে দেওয়া হয় না। তিতাসকে তিন কোম্পানিতে ভাগ করে আরও ক্লোজ মনিটরিং এবং ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ করা না হলে কোনোভাবেই অবৈধ ব্যবহার, পাইপলাইনে ছিদ্র, গ্যাসের অপচয় বন্ধ করা যাবে না।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন