ডিজিটাল প্রকল্পের নামে ডিএসআইয়ের লুটপাট
গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঘুষ-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকার চারটি প্রকল্প বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ডাইনামিক সলিউশনস ইনোভেটরস (ডিএসআই) নামের একটি সফটওয়্যার কোম্পানির বিরুদ্ধে। প্রভাব খাটিয়ে প্রকল্প পাওয়ার পর সেগুলোতে নিম্নমানের প্রযুক্তি ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রকল্পগুলোর মেয়াদ শেষ হলেও ফলপ্রসূ হয়নি।
সূত্র জানায়, সরকারের জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ ও তালাকের ডিজিটাল তথ্যভা-ার তৈরির সিআরভিএস প্রকল্প, মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল প্রোফাইল তৈরির আইইআইএমএস প্রকল্প, কৃষি খাতে সারের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিসিআইসি অটোমেশন প্রকল্প এবং একটি প্রাথমিক শিক্ষার প্রকল্প হাতিয়ে নেয় ডিএসআই। অভিযোগ রয়েছে, সফটওয়্যার কোম্পানিটি প্রকল্পগুলো ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়ন না করেই অর্থ আত্মসাৎ করে। ফলে প্রকল্পগুলোর কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এমন অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ডিএসআই আবার অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নতুন প্রকল্প হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে ডিএসআইয়ের অনিয়মের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখছে দুদক।
ডিএসআইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর আগেই ওই সব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর আগারগাঁও আইসিটি টাওয়ারে ‘এসপায়ার টু ইনোভেট’ (এটুআই) অফিসে অভিযান চালায় দুদক একটি দল। সেখান থেকে বিভিন্ন নথিপত্র সংগ্রহ করেন দুদক দলের সদস্যরা। প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়ার কথা বলা হয়।
ওই সময় অভিযানের দায়িত্বে থাকা দুদকের সহকারী পরিচালক রাজু আহমেদ বলেছিলেন, নির্দিষ্ট কোম্পানিকে বারবার কাজ দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া ও ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে প্রকল্পটির অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে সত্যতা মিলেছে। তিনি বলেন, প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে ১৪ জনের সংশ্লিষ্টতায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বারবার কাজ দেওয়া এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণসহ নানা উপায়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ রকম রেকর্ডপত্রও মিলেছে।
এই অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট দুদকের এক কর্মকর্তা গতকাল বৃহস্পতিবার আমাদের সময়কে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিগত সময়ে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, সেসব বিষয়ে একটি শক্তিশালী টিম অনুসন্ধান করছে। সেই টিমের কাছেই ডিএসআইয়ের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে। তিনি বলেন, আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই টিমের প্রতিবেদন পাওয়া যাবে; প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ডিএসআইর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, তালাকের তথ্য ডিজিটাল করতে ২০১৪ সালে সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (সিআরভিএস) প্রকল্প শুরু হয়। কক্সবাজার, জামালপুর ও গাইবান্ধায় পরীক্ষামূলকভাবে ওপেন সিআরভিএস চালু হলেও ২০২২ সালে প্রকল্পের মেয়াদ শেষে সারাদেশে আর সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি। এই প্রকল্পের বিষয়ে ওঠা অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, কোটি কোটি টাকা খরচের পরও তা সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২২ সালে প্রকল্প মেয়াদ শেষ হলেও এখনও তা জাতীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণ হয়নি, যেখানে ৪৭ কোটি টাকা থেকে শুরু হয়ে শতকোটি টাকা পর্যন্ত খরচের কথা বলা হচ্ছে।
সিআরভিএসের তথ্য এখনও দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে কাগজে-কলমে বা বিচ্ছিন্ন সফটওয়ারে পরিচালিত হয়। এতে দুর্নীতি ও পক্ষপাতমূলক চুক্তি করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে কোম্পানিটি নিম্নমানের সফটওয়্যার, প্রযুক্তি, অযৌক্তিক সফটওয়্যারের বিলিং ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়ম করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি ও সফটওয়্যারের দুর্বলতা নিয়ে মূল্যায়ন ও অডিট হলেও তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি।
বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও শিক্ষার্থীদের জন্য ইউনিক আইডি (ইউআইডি) ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে ২০১৮ সালে নেওয়া হয় ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (আইইআইএমএস) প্রকল্প। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য ডিজিটাল প্রোফাইল তৈরি করে তাদের শিক্ষা, ভর্তির ইতিহাস, পরীক্ষার ফলাফল ও উপস্থিতি একক প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণ করা। এ প্রকল্পের সময়সীমা ছিল জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত। এর বাজেট ছিল প্রায় ২৩ কোটি টাকা। ডিএসআই এই প্রকল্পও যোগসাজশে হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ৩ বছর আগে শেষ হলেও এখনও সিস্টেম চালু হয়নি। শুধু কিছু শিক্ষা বোর্ডে ও জেলা পর্যায়ে ইউআইডি তৈরির কাজ আংশিক সম্পন্ন করেছে। সরকারি তদন্ত ও বেশ কিছু রিপোর্টে দেখা যায়, প্রকল্পে ব্যবহৃত সফটওয়্যার ছিল অত্যন্ত দুর্বল ও তথ্য সংরক্ষণে সক্ষম নয়।
সাবেক এক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) কিছু অসৎ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে বিসিআইসির ‘ইন্টিগ্রেটেড বিজনেস প্রসেস অটোমেশন প্ল্যাটফর্ম’ প্রকল্পটি হাতিয়ে নেয় ডিএসআই। এ প্রকল্পটির জন্য ২০২৪ সালের জুনে ৪টি কোম্পানিকে শর্টলিস্ট করা হয়। জুলাই আন্দোলন চলাকালীন সময়ে দ্রুততায় ডিএসআইকে কাজ দেওয়ার জন্য একটি চক্র উঠে-পড়ে লাগে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর পূর্ববর্তী সরকারের মদদপুষ্ট কর্মকর্তাদের সহায়তায় তাদের কাজ দেওয়া হয়।
সম্প্রতি দেশে সারের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা এবং মজুদ থেকে ডিলার পর্যন্ত সারের সব তথ্য অনলাইনে নিয়ে আসতে ‘অনলাইন বেইজড ফার্টিলাইজার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নামক একটি টেন্ডারে ইতোমধ্যে উঠেছে যোগসাজশের অভিযোগ। বিসিআইসি ৫ আগস্টের পর ‘অনলাইন বেইজড ফার্টিলাইজার ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম’ দরপত্রে এমন শর্ত যোগ করেছে, যাতে কাজটি নির্দিষ্টভাবে ডিএসআইর কাছে যায়। বেসিস এ বিষয়ে তাদের উদ্বেগ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে, কিন্তু বিসিআইসি তা উপেক্ষা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ডিএসআইয়ের চিফ টেকনোলজি অফিসার (সিটিও) মোজাহিদুল হক আবুল হাসনাতের সঙ্গে যোগাযোগ চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির অফিসের মোবাইল নম্বরে কল করে সিটিওর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে অপর প্রান্ত থেকে বিষয়বস্তু জানতে চান। কিছুক্ষণের মধ্যে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানানো হবে আর ফোন ধরেনি।