চাপে পড়বে রপ্তানি খাত বোঝা বাড়বে ভোক্তার
বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্থরগতি চলছে। ব্যবসায়ীরা যখন টিকে থাকার লড়াই করছেন, তখন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সেবা খাতে গড়ে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ (মাশুল) বাড়িয়ে দিয়েছে। বন্দরের এ সিদ্ধান্তকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে বিবেচনা করছেন ব্যবসায়ীরা। এ জন্য এই মাশুল কমানোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, মাশুল না কমালে চাপে পড়বে দেশের রপ্তানি খাত। অন্যদিকে এই অতিরিক্ত চার্জের বোঝা আমদানি-রপ্তানিকারকদের ওপর পড়েলও শেষ পর্যন্ত সেটি ভোক্তার ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হবে, যাতে ভুগবে সাধারণ মানুষ।
চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন মাশুলের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগের তুলনায় গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কনটেইনার পরিবহনের মাশুল। এখন থেকে কনটেইনারপ্রতি (২০ ফুট লম্বা) বাড়তি মাশুল দিতে হবে ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। বন্দরের সেবা নেওয়ার জন্য এই মাশুল দিতে হবে বন্দর ব্যবহারকারীদের। গত ২৪ জুলাই বন্দরের প্রস্তাবিত মাশুল অনুমোদন করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। সেই সময় একসঙ্গে গড়ে ৪১ শতাংশ হারে মাশুল বাড়ানোর বিষয়ে আপত্তি জানান বন্দর ব্যবহারকারীরা। এরপর বিষয়টি নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে একদফা আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু ব্যবহারকারীদের আপত্তি আমলে না নিয়েই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ফলে মাশুল বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত বন্দর নিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সেটিই বহাল থাকল।
মাশুল বাড়ানোর বিষয়ে ব্যবহারকারীদের বড় আপত্তি ছিল একলাফে গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হলে তাতে হঠাৎ করে ভোক্তার ওপর চাপ বেড়ে যাবে। রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে। আবার ভবিষ্যতে বন্দরের দুটি টার্মিনাল ছাড়া সব কটিই যাচ্ছে বিদেশিদের হাতে। ফলে মাশুল বাড়ানো হলে তার বড় সুফল পাবেন বিদেশি অপারেটররা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট তাসকিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধি, বিশেষ করে প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারে অতিরিক্ত ট্যারিফ বৃদ্ধি ব্যবসার পরিবহন ব্যয় বাড়িয়ে আমদানি-রপ্তানি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বাড়তি চাপ তৈরি করবে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তামূল্যে প্রভাব সৃষ্টি করবে। ব্যবসায়ীরা সবসময় পূর্বানুমানযোগ্য নীতি ও স্থিতিশীলতা চান, যাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা সম্ভবপর হয়। ব্যবসায়ীরা শুরু থেকেই এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে এলেও তা উপেক্ষা করে এক লাফে ট্যারিফ বৃদ্ধির এমন সিদ্ধান্ত আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে। ঢাকা চেম্বার মনে করে, বন্দর সেবার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য যৌক্তিক সমন্বয় জরুরি হলেও তা অবশ্যই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে এবং ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা উচিত।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর তো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তারপরও বিগত বছরগুলোতে বন্দর তো কখনই লোকসান দেয়নি। তারা ধারাবাহিক লাভ করেছে। তাতে এ মুহূর্তে গড়ে প্রায় ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।’ এ জন্য বর্ধিত ট্যারিফ পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
বিকেএমইএ সভাপতি বলেন, গত ২৫ আগস্ট বৈঠকে ব্যবসায়ীদের সামনে ট্যারিফ বাড়ানো নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো যুক্তি দিতে পারেননি। ‘আমরা ট্যারিফ বাড়ানো নিয়ে উপদেষ্টা মহোদয়ের সামনে বলেছি, যে হারে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটি যুক্তিযুক্ত নয়। এখন এ ট্যারিফ বাড়ানোর কারণে তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। কারণ বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার তৈরি পোশাক খাত। একদিকে আমাদের উৎপাদন খরচ বাড়ল, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমতে থাকবে।’ এটি সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ট্যারিফ বাড়ানোর ফলে সরাসরি অ্যাফেক্টেড হবে পোশাক খাত। আমাদের কাঁচামাল আমদানির জন্যও বাড়তি ট্যারিফ দিতে হবে। আবার সেই কাঁচামাল দিয়ে তেরি পোশাক রপ্তানিতেও বাড়তি ট্যারিফ দিতে হবে। এমনিতেই আমেরিকায় আমাদের যে মার্কেট, সেটি গত কয়েক মাস ধরে ডাউন হয়ে আছে। ইউরোপের মার্কেট দিয়ে আমরা মোটামুটি কারখানাগুলো বাঁচিয়ে রেখেছি।
মাশুল বৃদ্ধির চাপ পড়বে ভোক্তার ঘাড়ে : ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরে কার্গো পণ্য হ্যান্ডলিং, জাহাজের বিভিন্ন খাতে চার্জ বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি পড়বে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে মোট ৫২টি খাতে মাশুল আদায় করে। সেখান থেকে ২৩টি খাতে সরাসরি বর্ধিত হারে মাশুল আদায় কার্যকর হয়েছে। মাশুল বাড়ানোর ক্ষেত্রে বন্দরের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছে স্পেনের প্রতিষ্ঠান আইডম। এশিয়ার ১০টিসহ ১৭টি আন্তর্জাতিক বন্দরের কার্যক্রম এবং ট্যারিফ পর্যালোচনা করেই চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, এখন জাহাজের ভাড়া বাড়বে, কনটেইনারে ভাড়া বাড়বে, ডেমারেজ চার্জ বাড়বে। কিন্তু মাদার ভ্যাসেলের যারা প্রিন্সিপাল তারা তো এই বাড়তি চার্জ দেবে না। এই অতিরিক্ত চার্জের বোঝাটা যাবে ম্যাক্সিমাম আমদানি-রপ্তানিকারকদের ওপর। তারা হিমশিম খাবে। আবার তারাও সেটা চাপিয়ে দেবে ভোক্তার ওপর। শেষ পর্যন্ত বোঝাটা বহন করতে হবে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকে।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, বাড়তি ট্যারিফ সার্বিকভাবে আমদানি-রপ্তানিকারকদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ বাড়তি টাকাটা তো তাদেরই পরিশোধ করতে হবে। এটার অবশ্যই বিরূপ প্রভাব পড়বে। সব মিলিয়ে বলতে গেলে চাপটা আসবে ভোক্তার ওপর। উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোর ওপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপবে।
চট্টগ্রাম কাস্টম এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম সাইফুল আলম বলেন, এটা আমাদের জন্য মাথায় আকাশ রভঙে পড়ার অবস্থা। এভাবে ট্যারিফ আদায় করা হলে সার্বিকভাবে খরচের বোঝা বেড়ে যাবে। এটা তো সাধারণ ভোক্তাদের ওপর গিয়ে পড়বে। আমদানি পণ্যের অতিরিক্ত খরচ তো শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হবে।
যেভাবে বাড়ল ট্যারিফ : গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৪১ শতাংশ হারে বর্ধিত মাশুল প্রস্তাব করে। ২ জুন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ট্যারিফ বিষয়ে এক মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা আপত্তি জানান। কিন্তু আপত্তি উপেক্ষা করে ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি হয়। গত রবিবার রাতে সরকারি প্রজ্ঞাপনটি জারি হয়; পর দিন সোমবার থেকেই কার্যকর করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
প্রজ্ঞাপন অনুসারে, সবচেয়ে বেশি মাশুল বেড়েছে কনটেইনার পরিবহণ খাতে। প্রতিটি ২০ ফুট লম্বা কনটেইনারে ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা থেকে ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা বেড়ে নতুন মাশুল দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা। আবার কনটেইনারবাহী জাহাজের ক্ষেত্রে আমদানি কনটেইনারের জন্য ৫ হাজার ৭২০
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, জাহাজের ওয়েটিং চার্জ বেড়েছে ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় ১০০ শতাংশ। কোনো জাহাজ নির্ধারিত সময়ে ভিড়তে না পারলে অর্থাৎ ওয়েটিং টাইম ১২ ঘণ্টার বেশি হলে ১০০ শতাংশ, ২৪ ঘণ্টার জন্য ৩০০ শতাংশ, ৩৬ ঘণ্টার জন্য ৪০০ শতাংশ এবং ৩৬ ঘণ্টার বেশি হলে অতিরিক্ত চার্জ ৯০০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই অতিরিক্ত চার্জের বোঝা আমদানিকারকদের এবং ক্ষেত্রবিশেষে রপ্তানিকারকদের বহন করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, প্রায় ৪০ বছর পর ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে। অথচ প্রতিবেশী বন্দরগুলোতে নিয়মিত হারে ট্যারিফ বাড়ে। ট্যারিফ বাড়ানোর পরও চট্টগ্রাম বন্দরে এর হার তুলনামূলক অনেক কম।