সাবেক এমপি কালামের অবৈধ সম্পদ পাহারায় ভাই-ভাতিজা
এক সময় চাল-তেল কেনারও সামর্থ্য ছিল না আবুল কালাম আজাদের। দোকানদাররা পর্যন্ত তাকে বাকিতে কিছু দিতেন না। সেই কালামই দীপু মনির আশীর্বাদে নৌকার টিকিট পেয়ে হয়ে যান এমপি। পরে পৌর মেয়র হিসেবে স্ত্রী শায়লা পারভীনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করান। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে রাতারাতি পুকুর, মার্কেট, ফ্ল্যাট ও জমির মালিক হয়ে তিনি গড়ে তোলেন হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য। মাটির ভাঙা বাড়ি থেকে রাজশাহী ও ঢাকায় আলিশান ফ্ল্যাট নির্মাণ, জামগ্রামে প্রাচীরঘেরা বাড়ি- এই ছিল তার সম্পদের প্রাথমিক অংশ। পৌর মেয়র থাকাকালীন হাজার বিঘা পুকুর ও বাজার দখল করে কালাম নিজের আর্থিক সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দোকান বরাদ্দের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
এক সময় নিষিদ্ধঘোষিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল লাল পতাকা) নেতা ছিলেন। পুলিশের তালিকায় ছিলেন দাগি সন্ত্রাসী। বেপরোয়া সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করাই ছিল তার কাজ। ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। তবে প্রাণে বেঁচে যান কালাম। এরপর থেকে এলাকায় তিনি ল্যাংড়া কালাম নামেই পরিচিত। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির আশীর্বাদে টিকিট পেয়েছিলেন নৌকার। রাজশাহী সফরে এলেই দীপু মনি উঠতেন কালামের বাসায়।
এর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই আবুল কালাম আজাদ দুই দফা পৌর মেয়র হন। দলীয় প্রভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অসীম ক্ষমতাধর। দখল করে রাতারাতি কয়েক হাজার বিঘা পুকুরের মালিক হন। গড়েন অঢেল সম্পদ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দিন ৫ আগস্ট বাড়ি ছেড়ে পরিবারসহ পালিয়ে যান কালাম। তারপর থেকে পড়ে আছে বাড়িটি। এমনকি তার চাপে হত্যা মামলার আসামির তালিকা থেকেও নাম কেটে দিতে বাধ্য হতো পুলিশ। ‘সেভেন স্টার’ বাহিনী গঠন করে গোটা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। নিজেও প্রকাশ্যেই কোমরে পিস্তুল ঝুলিয়ে ঘুরতেন এলাকায়। কথায় কথায় গুলি করে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দিতেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেই কালাম কারাগারে। তবে কালামের বিপুল সম্পদ এখন দেখাশোনা করেন তার ভাই হাশেম আলী, ভাতিজা হাবিবুর রহমান হাবু ও আশরাফ বাবু নামে এক ব্যক্তি। তারাই কালামের সম্পত্তি আগলে রেখেছেন। হাবু এখন অবশ্য এলাকায় থাকেন না।
স্থানীয়রা জানান, ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসন থেকে নৌকার টিকিটে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ। কালাম তাহেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার হলফনামায় প্রায় ১০০ একর পুকুরে মাছের খামারের কথা নিজেই উল্লেখ করেছিলেন। বছরে আয় এক কোটি টাকা। চড়তেন দেড় কোটি টাকা মূল্যের গাড়িতে। বাগমারার জামগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদের মাটির ভাঙাচোরা বাড়িটি এখনও আছে। ২০১১ সালে তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র পদে প্রথমবার নির্বাচন করেছিলেন এই বাড়ি থেকেই। স্থানীয়রা জানান, পৌর মেয়র হওয়ার পর ওই বাড়ির পাশেই কয়েক বিঘার জমির ওপর নির্মাণ করেন আলিশান বাড়ি। রাজশাহী মহানগরীর অভিজাত পদ্মা আবাসিক এলাকা ও ভদ্রায় রয়েছে তার তিনটি ফ্ল্যাট। ছোটবন গ্রামে জমি। ঢাকার ৩০০ ফিট এলাকাতে একটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। মেয়র হয়েও পৌরসভায় বিভিন্ন ব্যক্তির লাইসেন্সে নিজেই ঠিকাদারি কাজ করেছেন। প্রায় ৫ হাজার বিঘা পুকুরের মালিক কালাম। মেয়র থাকাকালে পৌর ভবনে বসেই তিনি মেতেছিলেন চাঁদাবাজি আর দখলদারিতে। তাহেরপুর বাজারের ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে পৌরসভার নামে অন্তত ৫টি মার্কেট নির্মাণ করে নিজের দখলে নিয়েছিলেন আবুল কালাম। অভিযোগ রয়েছে, পৌরসভার বিভিন্ন মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার নামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেওয়া শত কোটি টাকাও তুলেছেন নিজের পকেটে। সেলামির টাকা নিয়েও দোকান দেননি অনেকেই।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পৌর এলাকার হরিতলা বাজারের ব্যবসায়ী ইব্রাহিম জানান, আগে তিনি যেখানে ব্যবসা করতেন, সেখানে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে কালাম পৌরসভার নামে দোতলা মার্কেট নির্মাণ করেন। ওই মার্কেটে দোকান নিতে চার লাখ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু দোকান পাননি। ওই মার্কেটেও দোতলায় বিশাল জায়গায় তিনি স্ত্রী ও নিজের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে কে. কে ফ্যাশন হাউস করেন। এটির মালিক কালাম নিজেই। পৌর এলাকার ৩নং ওয়ার্ডের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পৌর সুপার মার্কেটে দোকান বরাদ্দে নেওয়ার জন্য আমি কালামকে ৪৫ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। কথা ছিল ৪টি দোকান দেবেন। কিন্তু আমাকে দুটি দিয়েছে। গোটা এলাকায় কালাম কায়েম করেছিলেন ত্রাসের রাজত্ব। গড়ে তুলেছিলেন ‘সেভেন স্টার বাহিনী’। এ বাহিনীর সদস্যরা হলেন- তাহেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মনসুর রহমান মৃধা, সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, কালামের ভায়রা (স্ত্রীর দুলাভাই) আনোয়ার হোসেন, যুবলীগ নেতা রাজু আহমেদ ও সোহেল রানা, আওয়ামী লীগ নেতা রতন সাহা এবং কালামের ভাতিজা হাবিবুর রহমান হাবু। মেয়র হওয়ার পর কালাম প্রকাশ্যেই ঘুরতেন পিস্তুল নিয়ে। কথায় কথায় হুমকি দিতেন গুলি করারও। ২০১৬ সালে গোয়ালকান্দি ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী আলমগীর সরকারের তালতলী মোড়ের জনসভায় তৎকালীন পৌর মেয়র কালাম প্রকাশ্যেই পিস্তুল কোমরে ঝুলিয়েই বক্তব্য রাখেন। কিন্তু পুলিশ তখন কালামের অপকর্মের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়নি।
বাগমারার শ্রীপুর ইউনিয়নের মজিদপুর গ্রামের সাবেক মেম্বার হাবিবুর রহমান জানান, এমপি হওয়ার পর তার জমির পাশে পুকুর কাটেন কালাম। কালাম তার জমিতেও পুকুর কাটতে চান। কিন্তু পুকুর কাটার জন্য জমি দিতে অস্বীকৃতি জানান হাবিবুর। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কালাম বাহিনী গভীর রাতে হাবিবুরের বাড়িতে গিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ভাঙচুর করে। এ সময় হাবিবুরের পায়ে গুলি করে কালাম বাহিনীর ক্যাডার কোরবান। পরদিন আবার অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে দুই লাখ চাঁদা আদায় করে তারা। এ ঘটনায় হাবিবুর বাগমারা থানায় মামলা করতে গেলে তৎকালীন ওসি মামলা নেননি।
স্থানীয়রা জানান, শ্রীপুর ইউনিয়নের খয়রা বিল ১০ হাজার একর আয়তনের। স্থানীয়দের আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক ২০১৩ সালের ১৪ অক্টোবর উন্মুক্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এক মাসের মাথায় স্থানীয় লোকজনের ওপর আগ্নেয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করে কালাম বাহিনী। এ সময় তাদের গুলিতে আশরাফুল নামে এক যুবক নিহত হন। ওই হত্যা মামলার প্রধান আসামি কালাম বাহিনীর অন্যতম প্রধান আওয়ামী লীগ নেতা ও শ্রীপুর ইউপি চেয়ারম্যান মকবুল মৃধা এবং তৎকালীন পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ। কিন্তু কালাম প্রভাব খাটিয়ে এই মামলা থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
জানা গেছে, ২০১৬ থেকে গত ২০২৪-এর ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের সভাপতি থাকাবস্থায় অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কামিয়েছেন প্রায় কোটি টাকা। তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের জমিতেও বদনজর পড়ে আবুল কালামের। তাহেরপুর ভূমি অফিসের পাশে খাসজমি কলেজের নামে লিজ নেওয়া ছিল। কিন্তু কালামের চাপের মুখে অবৈধভাবে দীর্ঘমেয়াদে ওই জমি লিজ দেন তৎকালীন ইউএনও। সেখানে তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন কালাম। তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক নজরুল ইসলাম ম-ল বলেন, ওই জমির ওপর যুগ যুগ ধরে কলেজের শিক্ষকদের ডরমেটরি ছিল। কিন্তু কালাম সেটি রাতারাতি দখল করে নিজেই বিল্ডিং করেছেন। এমপি হয়ে তিনি তাহেরপুর পৌরসভায় স্ত্রী শায়লা পারভীনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত করেন। কালামের ভয়ে অন্য কেউ আর মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস দেখাননি।
তাহেরপুর পৌরসভার বাসিন্দা শামসুর রহমান বলেন, কয়েক মাসের এমপি হয়ে কালাম তাহেরপুর পৌরসভা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানাকে সঙ্গে নিয়ে বাগমারা ও পাশের দুর্গাপুর উপজেলায় মানুষের জমি জোর করে দখল করে পুকুর কাটা শুরু করেন। মাত্র সাত মাসের মধ্যে বাগমারা ও দুর্গাপুরে অন্তত তিন হাজার বিঘা পুকুর খনন করা হয়। এর মাধ্যমে হাতিয়ে নেন প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তাহেরপুর বাজারে অন্তত ৮ কোটি টাকা মূল্যের একটি জমি দখল করে নেন। পরিবেশ ও জলবায়ু তহবিলের ১৩ কোটি টাকার একটি বিশেষ প্রকল্প পেয়েছিল তাহেরপুর পৌরসভা। এ প্রকল্পে ৪ কোটি ৯৮ লাখ ২৫ হাজার ২৫ টাকায় ৪১৫ মিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ ছিল। দুদক অভিযোগ পায়, টেন্ডারে থাকা পরিধির চেয়ে কম বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়; কিন্তু বিল পুরো কাজেরই তোলা হয়। ১০ মিটার কাজ না করলেও অতিরিক্ত ৩৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৬১ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি পৌরসভার মেয়র থাকাকালে জলবায়ু তহবিলের ওই প্রকল্পের ঠিকাদারদের কাছ থেকে আদায় করা ভ্যাট ও ট্যাক্সের ৫৫ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ টাকা আদায় করে তা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাতেরও অভিযোগ আছে। কৃষি ও পরিবেশ অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় ওই আর্থিক অনিয়ম ধরা পড়ে। আওয়ামী সরকারের পতনের পর সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি এখন কারাগারে আছেন।