কাঠের ব্লক দিয়ে শিল্পকর্ম বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই ভাই

রাতুল সাহা, বুটেক্স
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কাঠের ব্লক দিয়ে শিল্পকর্ম  বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই ভাই

পেইন্টিংয়ে আমরা সাধারণত দেখি রং, তুলি আর ক্যানভাসের ব্যবহার। কিন্তু ছোট ছোট রঙিন কাঠের ব্লক দিয়েও যেকোনো দৃশ্য বা অবয়ব ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। এই কাঠের ব্লকগুলো ডিজিটাল পিক্সেলের মতো কাজ করে এবং আর্টগুলো দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয় যা দেখতে অনেকটা পেইন্টিংয়ের মতো। শিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে এমনি ব্যতিক্রমী কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই ভাইয়ের তৈরি করা পিক্সেল স্টুডিও। তারা হলেন গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী মেহরাজ হোসেন শাওন এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সায়মন হোসেন রাতুল।

করোনা মহামারীতে দেশে লকডাউনের ফলে শাওন ও রাতুলের বাবার ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ায় কিছুদিন পরেই তাদের বাবার স্ট্রোক হয়, যার ফলে তাদের পরিবার কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। তখন দুই ভাই সিদ্ধান্ত নেন পরিবারের উপার্জনে অবদান রাখতে নতুন কিছু শুরু করার। শৈশব থেকেই দুজনের শিল্পের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা ছিল। তবে প্রচলিত চিত্রকলা খুব সাধারণ এবং বিক্রি করাও বেশ কঠিন। অনেক গবেষণা করার পর তারা পিক্সেল আর্ট সম্পর্কে জানতে পারেন। এই শিল্পকর্ম সাধারণত কাঠের ব্লক ব্যবহার করে তৈরি করা হয়, যা দিয়ে যেকোনো দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব।

২০২১ সালের জুন মাসের দিকে দুই ভাই মাত্র ১০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। প্রথম দিকে তারা একটি ডিজাইন নিয়ে কাজ করে ধীরে ধীরে অর্ডার পেতে শুরু করেন এবং সেখান থেকে অর্জিত অর্থ পুনরায় ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলেও পড়াশোনার কারণে কাজটি অধিক সময় করতে পারতেন না তারা। পরীক্ষা চলাকালে তাদের কাজ বন্ধ থাকত এবং যার ফলে গ্রাহকরা বিরক্ত হতেন। শুরুর দিকে তারা নিজেদের বেডরুমে কাজ করতেন। কিন্তু পরে উপলব্ধি করেন, ব্যবসা বড় করতে হলে কর্মী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। এরপর তারা একটি ছোট কারখানা চালু করেন এবং সেখানে কয়েকজন মহিলা কর্মী নিয়োগ দেন। শুরুতে কর্মীরা কাজ বুঝতে না পারায় কিছু সমস্যার সম্মুখীন হলেও কয়েক মাস পর তারা দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং নিখুঁতভাবে কাজ করতে শুরু করেন। বর্তমানে তাদের শিল্পকর্ম বাংলাদেশ মিলিটারি মিউজিয়াম, ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট, ব্রুভানা গ্রুপসহ দেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহে জায়গা করে নিয়েছে।

তাদের যাত্রার শুরুটা নিয়ে মেহরাজ হোসেন শাওন বলেন, “ছোটবেলা থেকেই আমার নতুন কিছু বানানোর তীব্র আগ্রহ ছিল। যেমন- ঘুড়ি, প্লেন, পাথর, মাটি ইত্যাদি দিয়ে জিনিস বানিয়ে সময় কেটেছে আমার। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছা থাকলেও বিষয়টি পাইনি। তাই হাতে কিছু করা যায়, বানানো যায় সেই চিন্তা থেকে স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হলাম। প্রথম বর্ষে থাকাকালে কাঠের ব্লকে করা রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রটে আমাকে ভাবিয়েছিল- এই কাজগুলো বিক্রি করা যায় কিনা। করোনার সময় পরিবারে সংকট, বাবার অসুস্থতা ও পুরনো সেই রবীন্দ্রনাথের পিক্সেল প্রজেক্টটা দেখে বড় বোনের বলা একটি কথাই ছিল ট্রিগার পয়েন্ট- এই কাজগুলো তো সেল করা যায়।

আমার ছোট ভাই রাতুলও আঁকিবুকি করা, আয়রন ম্যান, স্পাইডারম্যানের মতো ফ্যান্টাসি ক্যারেক্টার নিয়ে ছোটকাল থেকেই পড়ে থাকত। নতুন কিছু বানানোর প্রতি তারও ভীষণ আগ্রহ ছিল। তাই ছোট ভাই রাতুলের সঙ্গেই কাজ শুরু করি। প্রথম অর্ডারে কোনো অ্যাডভান্স না পেয়ে নিজেদের টাকা দিয়ে কাজ করি। সেই একটি শুরু থেকে আজ পিক্সেল স্টুডিও পৌঁছেছে আন্তর্জাতিক মানের। পিক্সেল স্টুডিওর মূলমন্ত্র একটাই, সেটা হলো- ভিন্ন কিছু করা।’

সায়মন হোসেন রাতুল তার ব্যবসার ধরন ও প্রণালি উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার ব্যবসাটি মূলত একটি আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট ব্যবসা। প্রথমে আমরা থ্রি-ডি মডেল তৈরি করি। তারপর স মিল থেকে সে অনুযায়ী কাঠের অতিরিক্ত টুকরোগুলো কেটে আনি। এরপর সেগুলো রং করি এবং প্লাইউডের ওপর বিভিন্ন ধরনের আকৃতি বসাই। এই আর্টগুলো দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয় যা দেখতে অনেকটা পেইন্টিংয়ের মতো। একে থ্রি-ডি ওয়াল আর্টও বলে। আমাদের সাউন্ড ডিফিউজার নামে আরেকটি সেক্টর রয়েছে যেটি সাউন্ড ইকোকে এলিমিনেট করতে কাজ করে। ইউরোপে এই শিল্পধারা বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু আমরাই এটি তৈরি করি।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে তারা জানান, আমরা পিক্সেল স্টুডিওকে আরও বিস্তৃত করতে চাই এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশে এই ধরনের পিক্সেল আর্টের জনপ্রিয়তা বাড়াতে চাই। এ ছাড়া নতুন কর্মী নিয়োগ, প্রযুক্তির সাহায্যে উৎপাদন প্রক্রিয়া আরও উন্নত করা এবং বহু দেশের বাজারে আমাদের পিক্সেল আর্ট পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি বৃদ্ধির জন্য একটি ওয়েবসাইট অথবা অ্যাপ তৈরির পরিকল্পনা করছি।

যাতে আমাদের পণ্য সারাদেশে সহজেই পৌঁছাতে পারি।

তাই আমি বিশ্বাস করি, আমাদের তৈরি এই পিক্সেল আর্ট বাংলাদেশের প্রতিটি শিল্পপ্রেমীর দেওলে শোভা পাবে। আমি চাই, আমাদের তৈরি এই শিল্পকর্ম প্রতিটি বাসা এবং অফিসের অঙ্গনকে সাজাক।