জৈব সারে টেকসই হতে পারে কৃষি

চপল মাহমুদ
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
জৈব সারে টেকসই হতে পারে কৃষি

রাসায়নিক সারের ওপর শতভাগ নির্ভরতা কমিয়ে কৃষিতে আসছে টেকসই পরিবর্তন। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, মাটির উর্বরতা রক্ষা ও পরিবেশ সুরক্ষায় জৈব সার এখন কৃষকের নতুন ভরসা হয়ে উঠছে। তবে সচেতনতার অভাব, বাজারজাতকরণের দুর্বলতা ও উচ্চমূল্যের কারণে এখনও অনেক কৃষক পর্যাপ্ত ব্যবহার করতে পারছেন না। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অধিকাংশ জমিতে জৈব পদার্থ এক শতাংশেরও কম, যেখানে প্রয়োজন অন্তত তিন শতাংশ। এ জন্য কম্পোস্ট, সবুজ সার ও কৃষি ব্যবস্থায় ব্যবহার বাড়ানো অপরিহার্য।

সরকারি তথ্যে জানা যায়, দেশে বছরে জৈব সারের চাহিদা প্রায় ৬-৬.২ কোটি টন হলেও উৎপাদন সম্ভাবনা মাত্র ৪.৫-৫.৫ কোটি টন। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টন। উদ্যোক্তা সংখ্যা প্রায় ২৭ হাজার হলেও বাণিজ্যিকভাবে সক্রিয় আছেন মাত্র ১ হাজার ২০০ জন।

কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে জৈব সার ব্যবহার অনেকটা চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তরুণ উদ্যোক্তারা এগিয়ে এসেছেন। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বড় হামকুড়িয়া গ্রামের রাশেদ ২০২১ সালের জুনে মাত্র ৫০-৬০ হাজার টাকা মূলধন দিয়ে ‘রাশেদ স্মার্ট অ্যাগ্রো ফার্ম’ নামে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করেন।

তিনি জানান, ‘শুরুর দিকে মাসে চার-পাঁচ টন উৎপাদনের লক্ষ্য ছিল। দুই বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫-৪০ টনে। স্থানীয় ডিলার, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং বড় কোম্পানির কাছে সার বিক্রি করে মাসে গড়ে ১ লাখ টাকা আয় করছি। সঠিক দিকনির্দেশনা ও বাজার সহায়তা পেলে এ খাতে তরুণ উদ্যোক্তারা সহজেই সাফল্য অর্জন করতে পারবে।’

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের যুব উদ্যোক্তা রুবেল হোসেন বলেন, ‘কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণে এই ব্যবসা শুরু করেছি। স্থানীয় বাজারে চাহিদা এত বেশি যেম অর্ডার মেটানোও মুশকিল হয়ে যায়।’

নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণও এ খাতে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন অঞ্চলের নারী উদ্যোক্তারা ছোট ও মাঝারি আকারের কম্পোস্ট খামার পরিচালনা করছেন, যা স্থানীয় কর্মসংস্থান এবং নারী ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এমন একজন যশোরের ঝিকরগাছার বারবাকপুর গ্রামের নারী উদ্যোক্তা নাসরিন সুলতানা। তিনি ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ২০১৬ সালে মাত্র ১০০ গ্রাম কেঁচো দিয়ে শুরু করা তার উদ্যোগে এখন মাসে প্রায় ৩০ মণ সার উৎপাদন হয়, আয় হয় ১০-১২ হাজার টাকা। নিজের পড়াশোনার খরচ বহন করার পাশাপাশি তিনি এলাকার অনেক নারীকে কর্মসংস্থানের পথে যুক্ত করেছেন এবং নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও সামাজিক সচেতনতার কাজেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।

সরকারি তথ্য ও গবেষণা অনুযায়ী, দেশজুড়ে প্রায় ২৭ হাজার উদ্যোক্তা জৈব সার উৎপাদনে যুক্ত। এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে সক্রিয় আছেন প্রায় ১ হাজার ২০০ জন, যাদের মধ্যে ২৫০-২৭০ জন মাসিক পাঁচ টনের বেশি উৎপাদন করেন। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. বেগম সামিয়া সুলতানা বলেন, ‘গ্রাম থেকে শহরের ছাদ পর্যন্ত জৈব সারের চাহিদা বেড়েই চলছে। উদ্যোক্তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মাসে প্রায় ৪ হাজার টন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন হচ্ছে, যা বার্ষিক ৪৮ হাজার টন চাহিদা পূরণের নির্দেশনা দেয়।’ তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ মেট্রিক টন ভার্মি ও ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদন করা হয়।’

জানা যায়, ২০০৬ সালের ফার্টিলাইজার ম্যানেজমেন্ট আইন অনুযায়ী জৈব সারের মান নিয়ন্ত্রণ ও লাইসেন্স প্রদান করা হচ্ছে। জৈব সার নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান, উদ্যোক্তা তৈরি, ডেমো প্লট, রাসায়নিক সার নির্ভরতা হ্রাস, সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয়ের কাজ করছে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে জৈব সার উৎপাদন, উৎপাদন ও বিপণন বৃদ্ধিতেও কাজ করছে।

২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৮ লাখ ২৯ হাজার ২৬৬ হেক্টর, যা প্রায় ২ কোটি ১৭ লাখ একরের সমান। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বা ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার একর। সেই হিসেবে বাংলাদেশে উঁচু, মাঝারি উঁচু ও মাঝারি নিচু কৃষিজমির ৭৫ শতাংশের প্রতি হেক্টরে গড়ে ৩ থেকে ১০ টন জৈব সার প্রয়োজন। এর ভিত্তিতে দেশের মোট চাহিদা বছরে প্রায় ৬-৬.২ কোটি টন। কিন্তু উৎপাদন সম্ভাবনা মাত্র ৪.৫-৫.৫ কোটি টন। পশুপাখির মল, বাজার ও শিল্প-উপজাত থেকে বছরে ১৩-১৫ কোটি টন কাঁচামাল পাওয়া যায়। বর্তমানে ৪০-৫৫টি কোম্পানি এবং ২০-২২ হাজার ক্ষুদ্র উৎপাদক বাণিজ্যিকভাবে জৈব সার উৎপাদন করছেন। তবে সেকেলে প্রক্রিয়ায় অনেক সময় সারের পুষ্টি নষ্ট হচ্ছে।

বাংলাদেশ ভার্মি কম্পোস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বদরুল হায়দার ব্যাপারী বলেন, ‘সচেতনতার অভাব, প্রচার-প্রসারের ঘাটতি এবং বাজারজাতকরণে সহযোগিতা না থাকা বড় চ্যালেঞ্জ। উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করলে কয়েক বছরের মধ্যে জৈব সারের ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলেন, জৈব সারের মূল চ্যালেঞ্জ হলো উৎপাদনের মান নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন ও সংরক্ষণের ব্যয় এবং জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত ডেটার অভাব। তবুও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, স্থানীয় কৃষক এবং নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ খাত ভবিষ্যতে বাংলাদেশের টেকসই কৃষির মূল শক্তি হয়ে উঠতে পারে।

কৃষকরা জানান, ধান, সবজি ও ফলে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটি নরম থাকে, সেচ কম লাগে, রোগবালাই কমে এবং ফসলের স্বাদ ও মান উন্নত হয়। তবে প্রান্তিক কৃষকরা অভিযোগ কটরেন, সার সহজলভ্য না হওয়া, উচ্চমূল্য ও ভেজাল সারের কারণে নিয়মিত ব্যবহার করা কঠিন।

কৃষি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, তরুণ এবং নারী উদ্যোক্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সরকারের সহায়তা এবং স্থানীয় কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জৈব সার খাতটি বাংলাদেশের টেকসই কৃষির শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে গড়ে উঠছে। এটি পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে মিলিয়ে দেশের কৃষিকে নতুন দিগন্তে নিয়ে আসছে।