প্লট বিক্রির ৬ কোটি টাকা উধাও, ঝুলছে মামলা
কাউনিয়া প্রকল্পে সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর দুর্নীতি
বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর আমলে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর একের পর এক বেরিয়ে আসছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি হলো- কাউনিয়া আবাসিক প্রকল্প-২। এখানে প্লট বিক্রির ডাউন
পেমেন্ট বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা ৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবে নেই। স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, নিয়মভঙ্গ এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে পুরো প্রকল্পটি এখন আদালতের নিষেধাজ্ঞায় আটকে আছে।
২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ কাউনিয়া আবাসিক প্রকল্প-২ শুরু করেন। স্থানীয়দের চলাচলের রাস্তা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উপেক্ষা করে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ প্রকল্প চালু করা হয়। এলাকাবাসীর আন্দোলন, প্রতিবাদ ও আপত্তি সত্ত্বেও প্রকল্প চালু রাখা হয়।
এক বছর পর ২০২৩ সালে ২৪০টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের জারি করা বিজ্ঞপ্তির নিয়ম-কানুন মানা হয়নি। দলীয় নেতা-কর্মী ও ঘনিষ্ঠ মহলকে একাধিক প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। নগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুলের নামেই ১৪টি প্লট বরাদ্দের অভিযোগ উঠেছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্লট বরাদ্দের জন্য প্রায় ১০ হাজার আবেদনকারী ৩ হাজার টাকা করে ফরম কিনেছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। বরং গোপনে দলীয় মহলে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল গ্রাহকরা ডাউন পেমেন্ট বাবদ ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৮১ হাজার ৩৪৬ টাকা বরিশাল আইএফআইসি ব্যাংকের হিসাবে জমা দেন; কিন্তু নির্ধারিত ০০০০৩৬৭০৪০০৪২ নম্বর হিসাবে ওই অর্থের কোনো হদিস নেই। অভিযোগ- তৎকালীন মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ বিধি ভঙ্গ করে অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করেছেন।
বিসিসির সাবেক মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর বিতর্কিত কর্মকা-ের মধ্যে একটি ছিল বিভিন্ন খাতের টাকা নির্দিষ্ট হিসাবে জমা না দেওয়া। ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যা ইচ্ছে তা-ই করতেন। প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না কারোই। কেউ কিছু বললে করা হতো চাকরিচ্যুত না হয় ওএসডি। ফলে কর্মকর্তারাও ভয়ে কিছু বলতেন না। গুঞ্জন ছিল- বিসিসির বিভিন্ন খাতের টাকা তিনি ব্যাংকে জমা না করে আত্মসাৎ করেছেন। বিসিসির বর্তমান প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবে বলে জানিয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে দেশপালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর জ্যেষ্ঠ সন্তান সেরনিয়াবাত ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর কাউনিয়া আবাসিক প্রকল্প-২ চালু করেন। প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই প্রকল্প এলাকাবাসীর আন্দোলন ও আপত্তিকে তোয়াক্কা না করেই চালিয়ে যান। এ ছাড়াও হাতিয়ে নেওয়া হয় বেশ কিছু প্লট। হাতিয়ে নেওয়া প্লটের বেশির ভাগ ছিল সাদিকের সব অপকর্মের সেকেন্ড ইন কমান্ড-খ্যাত নগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুলের নামে, যার সংখ্যা ১৪টি। স্থানীয় বাসিন্দা, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশীকে বঞ্চিত করে নিজ দলীয় কর্মী-সমর্থকের মাঝে ৪-৫টি করে প্লট ভাগবাটোয়ারা করে দিয়েছেন সাদিক আবদুল্লাহ।
বিসিসির বাজেট কর্মকর্তা ও প্রধান হিসাবরক্ষক মশিউর রহমান বলেন, আমি বিসিসিতে চাকরি করি ৩৩ বছর। জমি বিক্রি করে আমাদের যে টাকা আয় হয়েছে তা প্রথমে আইএফআইসি ব্যাংকে জমা হয়েছে, সেখান থেকে তৎকালীন মেয়র অন্যত্র স্থানান্তর করে ব্যয় করেছেন, যেটা সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত। এই টাকা দিয়ে অন্য স্থানে স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করা যেত, যা তিনি করেননি। আইনকে তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছেমতো সব কিছু করেছেন। এক খাতের টাকা অন্য খাতে নেওয়াটা গুরুতর অপরাধ। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর সার্চিং দিয়ে দেখেছি যে, ওই অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই। টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা হয়েছে। মেয়রের নির্দেশ পালন না করলে কপালে যা হওয়ার তা-ই হয়। ওই মেয়র বিসিসির ২৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিনা অপরাধে চাকরিচ্যুত করেছেন, আমিও তার মধ্যে একজন। উনি ছিলেন বেপরোয়া এবং ওয়াদা খেলাপকারী একজন জনপ্রতিনিধি।
বিসিসির স্টেট অফিসার মাহবুবুর রহমান বলেন, প্লট বরাদ্দের নিয়ম ছিল প্রকাশ্যে লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া; কিন্তু কোনো কিছুই করা হয়নি। বরং অনিয়ম করা হয়েছে।
বিসিসি সূত্রে জানা গেছে, নগরীর কাউনিয়া এলাকায় ৭ একর জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই হাউজিংয়ের প্লট বরাদ্দের জন্য দশ সহস্রাধিক নগরবাসী আবেদন করেন। কথা ছিল- বিসিসি এলাকার মধ্যে যাদের জমি-ঘর আছে তারা প্লটের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। নিয়ম অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিক্তিতে প্লট বিতরণ ও এর উন্নয়ন না হওয়ায় স্থানীয় জনগণ প্লটের পুরো কার্যক্রমের ওপর উচ্চ আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা আনেন। স্থানীয় বাসিন্দা গাজী মকবুল হোসেন হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নং-১৮৯০/২০২২ দায়ের করেন। রিটকারীর পক্ষে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জাফর আহম্মেদ ও বিচারপতি মো. বসির উল্লাহের দ্বৈত বেঞ্চ ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট কাউনিয়া আবাসিক প্রকল্প ২-এর অবৈধ কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ প্রদান করেন।
স্থানীয় ভুক্তভোগী বাসিন্দা মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, কথা ছিল- বিসিসি এলাকার মধ্যে যাদের জমি-ঘর আছে তারা প্লটের দাবি করতে পারবেন না; কিন্তু মেয়র নিয়মনীতি উপেক্ষা করে নিজের দলীয় লোকজনকে প্লট বিতরণ করেন। আমাদের কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। আমরা মামলা করে কার্যক্রম স্থগিত করে রেখেছি। নুরুল ইসলাম শরীফ নামে স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, প্রতিটি ফরম ৩০০০ টাকা করে প্রায় দশ হাজার মানুষ ফরম কেনেন; কিন্তু রাতের অন্ধকারে বরাদ্দের কাজ সেরে ফেলা হয়। আমাদের প্রশ্ন- টাকাগুলো কোথায় গেলো। কেন সিটি বিধি উপেক্ষা করা হলো তা আমরা জানতে যাই।
জানা গেছে, ১৯৬১ সালে যখন জনস্বার্থের দোহাই দিয়ে ময়লাখোলা করার জন্য আমাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়, বিসিসি তখ কিছুদিন ময়লা ফেলে এই জমি নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে প্লট বিক্রি শুরু করে। আমার বাসার সামনে থেকে আমি বের হতে পারি না, অগ্রাধিকার উপেক্ষা করে অন্য লোককে এই জমি দেওয়া হয়েছে। জনস্বার্থ ব্যাহত হওয়ায় জেলা প্রশাসন এ জমির খাজনা নেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
বিসিসির প্রশাসক ও বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. রায়হান কাওছার বলেন, কাউনিয়া আবাসিক প্রকল্প-২ নিয়ে আদালতে মামলা চলমান। নিষ্পত্তি হলে করণীয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্লট বিক্রির কিস্তির টাকা অ্যাকাউন্টে না থাকার বিষয়টি শুনেছি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জেনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, ২৪০টি প্লট এলাকার জমির সর্বমোট মূল্য ধরা হয়েছে ১৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।