থেমে গেল আপসহীন যোদ্ধার কলম
লেখক-গবেষক, রাজনীতিক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর আর নেই। গতকাল রবিবার সকালে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকার একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন সকাল ১০টা ৫ মিনিটে তিনি মারা যান। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন।
বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাম-লীর সদস্য, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। তারা বলেন, বদরুদ্দীন উমর শুধু একজন তাত্ত্বিক ছিলেন না, ছিলেন একজন সংগ্রামী, যিনি আজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। তার মৃত্যু জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। শোকবার্তায় তারা মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবার, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নচারী এবং আপসহীন কলমসৈনিক বদরুদ্দীন উমরের জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার এক বনেদি পরিবারে। বাবা আবুল হাশিম ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী।
দাদা আবুল কাশেমও ছিলেন রাজনীতিবিদ ও বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য। তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বিশাল এক রাজনৈতিক পরিবেশে।
দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে বদরুদ্দীন উমর পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। পড়াশোনা করেছেন বর্ধমান রাজ কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ¯œাতকোত্তর শেষ করে খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে তিনি যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগেও শিক্ষকতা করেন তিনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সমাজ-বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সার্বক্ষণিক লেখালেখি শুরু করেন বদরুদ্দীন উমর। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিতেও (মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ) যোগ দেন। ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত সম্পাদনা করেন পার্টির মুখপত্র ‘গণশক্তি’ পত্রিকা। ‘সংস্কৃতি’ নামে তিনি আরেকটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রসার ও নেতৃত্ব গড়ে তোলার কাজে আমৃত্যু ব্যাপৃত ছিলেন।
লেখালেখি ছিল তার জীবনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। রাজনৈতিক সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বাঙালি মননের জগতে বদরুদ্দীন উমর এক বিশেষ ধারা সৃষ্টি করেছেন। তিনি শতাধিক গ্রন্থ ও অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এর মধ্যে ষাটের দশকে প্রকাশিত তার তিনটি বই- ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘সংস্কৃতির সংকট’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। তার সর্বজনস্বীকৃত কৃতী হচ্ছে তিনটি বিশাল খ-ে ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থ। এ রচনার কারণে তাকে ভাষা আন্দোলনের সাহিত্যিক স্থপতি হিসেবেও অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশের সৃষ্টিতে রাজনৈতিক ইতিহাস ও বিশ্লেষণাত্মক লেখাও তিনি লিখেছেন। তার ‘ঞযব ঊসবৎমবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয’ বইটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পুলিশি শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্যবাদী দর্শন ও সামাজিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির তিক্ত বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সংগ্রামী চেতনায় উমর তার চিন্তাশীল লেখনীর মাধ্যমে সমাজকে নতুনভাবে বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
২০২৫ সালে অন্তর্বর্তী সরকার তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রদানের জন্য মনোনীত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ নিয়ে তার বক্তব্য ছিল, এর আগেও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে তাকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করলেও তিনি কোনোটিই গ্রহণ করেননি। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের বাম-বুদ্ধিজীবী ও তাত্ত্বিক সমাজে একটি যুগের পরিসমাপ্তি ঘটল বলে অনেকে মনে করেন।
মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম অগ্রনায়ক, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও লেখক বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা ম-লীর সদস্য, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
প্রধান উপদেষ্টার শোক : বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, শিক্ষক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করা বদরুদ্দীন উমর ছিলেন আমাদের মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতি সংগ্রামের এক উজ্জ্বল বাতিঘর। ভাষা আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা, গবেষণা, ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শনের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। তার মৃত্যু জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তাশীল মানুষদের জন্য তার লেখনী ও জীবনদর্শন এক অনন্য পথনির্দেশ হিসেবে কাজ করবে।
উপদেষ্টাম-লীর শোক : বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলমসহ উপদেষ্টাম-লীর সদস্যরা। গতকাল পৃথক শোকবার্তায় তারা মরহুমের বিদেহি আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তারা বলেন, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে তার নির্ভীক ও আপসহীন ভূমিকার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে এই দেশ ও জাতি স্মরণ করবে।
বিএনপি ও তারেক রহমানের শোক : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গতকাল নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এক শোকবার্তায় বলেন, স্বৈরতন্ত্রকে উপেক্ষা করে বদরুদ্দীন উমর তার স্বাধীন মতামত প্রকাশে কখনোই কুণ্ঠিত হননি। তিনি ছিলেন স্বাধীন বিবেকের এক প্রতীক। তার জীবনাবসানে বিএনপি ও আমি গভীরভাবে মর্মাহত। বদরুদ্দীন উমরের বিদেহি আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকাহত পরিবার-পরিজন ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি সমবেদনা জানান তারেক রহমান।
পৃথক শোক বার্তায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমৃত্যু তিনি (বদরুদ্দীন উমর) জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করেছেন ও কলম ধরেছেন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ।
জামায়াতের শোক : বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গতকাল এক শোকবার্তায় দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, বদরুদ্দীন উমর ছিলেন একজন খ্যাতিমান লেখক, গবেষক ও বামপন্থি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদ, ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে তার রচিত গ্রন্থগুলো মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব সময়ে সাংস্কৃতিক চেতনা গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে এবং স্বাধীনতার আন্দোলনে প্রভাব বিস্তার করে। তিনি গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বহু অবদান রেখে গিয়েছেন। বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও তার রুহের মাগফিরাত কামনা করেন মিয়া গোলাম পরওয়ার।
এনসিপির শোক : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষ থেকে গতকাল এক শোক বার্তায় বলা হয়, একজন গবেষক ও লেখক হিসেবে বদরুদ্দীন উমর তার লেখনীতে বস্তুনিষ্ঠ এবং নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস তুলে ধরতেন। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের মুজিববাদী পাঠের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমরা এক অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছি।
জেএসডির শোক : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব শোক প্রকাশ করে বলেন, বদরুদ্দীন উমরের অসীম জ্ঞানের আলো, ইতিহাস ও রাজনীতির ওপর লেখা অসংখ্য গ্রন্থ, অবিস্মরণীয় রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক অবদান; মানুষের প্রতি আন্তরিক দায়বদ্ধতা দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে চিরকাল সমৃদ্ধ করে গেছে। ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার অবদান চিরস্মরণীয়। তার মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
গণসংহতি আন্দোলনের শোক : গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল এক শোকবার্তায় বলেন, আপস বদরুদ্দীন উমরের অভিধানে ছিল না। তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা যখন ফ্যাসিবাদের ছায়ায় নিজেদের নিরাপদ রাখতে চেয়েছেন তখন তিনি সত্য উচ্চারণ করেছেন নির্ভীকচিত্তে। তার জীবন ও কর্মের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
বাংলা একাডেমির শোক : বদরুদ্দীন উমরের প্রয়াণে এক শোক বার্তায় বাংলা একাডেমি বলেছে, মহান ভাষা আন্দোলনের প্রামাণ্য ইতিহাসপ্রণেতা হিসেবে তিনি যেমন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তেমনি সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির নানা বিষয়ে তার বিশ্লেষণী প্রবন্ধ-গবেষণা আমাদের অনন্তকাল ঋদ্ধ করবে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
উদীচীর শোক : উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাবিবুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন গতকাল এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, প্রায় শতাব্দীজুড়ে এই ভূখ-ের নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের লড়াইয়ে বদরুদ্দীন উমর নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে যে অবদান রেখে গেছেন তা ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান হয়ে থাকবে।
জাতীয় কবিতা পরিষদের শোক : জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মোহন রায়হান এবং সাধারণ সম্পাদক কবি রেজাউদ্দিন স্ট্যালিন এক শোকবার্তায় বলেন, বদরুদ্দীন উমর ছিলেন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক, যিনি গণমানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রামে আজীবন কলম ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই।