বোয়িংয়েই ঝুঁকছে বিমান বাংলাদেশ

গোলাম সাত্তার রনি
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বোয়িংয়েই ঝুঁকছে বিমান বাংলাদেশ

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে যুক্ত হতে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ। নতুন ১৪টি উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে উড়োজাহাজ সরবরাহ করতে প্রতিযোগিতায় করছে উড়োজাহাজ নির্মাতা দুই জায়ান্ট কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং ও ইউরোপের এয়ারবাস। প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের উড়োজাহাজ কেনার জন্য বিমান বাংলাদেশের কাছে পৃথক প্রস্তাবও দিয়েছে। তাদের প্রস্তাবগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করছে বিমান কর্তৃপক্ষ। তবে এই দৌড়ে অনেকখানি এগিয়ে বোয়িং। সূত্রে জানা গেছে, এর পেছনে রয়েছে মূলত মার্কিন শুল্ক নিয়ে দরকষাকষিতে দেওয়া শর্তের প্রভাব।

বিমান সূত্র বলছে, এরই মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টেকনিক্যাল ফাইন্যান্সিয়াল কমিটি চারটি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার কেনার বিষয়ে মতামত দিয়েছে। ২০২৬ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০৩২ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে এই মডেলের উড়োজাহাজগুলো হাতে পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাকি ১০টি উড়োজাহাজও বোয়িংয়ের হবে বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করছে তারা।

জানা গেছে, নতুন উড়োজাহাজ কিনতে ইতোমধ্যে বোয়িং ও এয়ারবাস কোম্পানি ১৪টি করে এয়ারক্র্যাফট বিক্রির প্রস্তাব দাখিল করেছে। বিমানের নিয়মানুসারে দুটি প্রস্তাব নিয়েই টেকনো ফিন্যান্সিয়াল কমিটির কাছে মূল্যায়নের কাজ চলমান রয়েছে। এর অংশ হিসেবে কমিটি প্রতি সপ্তাহে একটি করে বৈঠক করছে। বৈঠকে কোন যন্ত্রাংশ কাদের থেকে কিনলে সরকার লাভবান হবে তা নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ আগস্ট ২১ বিমানের সদরদপ্তরের বলাকা সম্মেলনকক্ষে এ নিয়ে একটি বৈঠক হয়। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বোয়িংয়ের দেওয়া প্রস্তাবে ১৪টি এয়ারক্রাফটের মধ্যে ১০টি ৭৮৭-১০ মডেলের এবং ৪টি ৭৮৭-৯ মডেলের বিমান রয়েছে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৭৮৭-১০ মডেল বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে এর বদলে ৭৮৭-৯ মডেলের ৪টি বিমান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একইসঙ্গে এয়ারবাসকে এ৩৫০-৯০০ বিমানের ৩-৩-৩ আসন বিন্যাসের নতুন পরিকল্পনা দিতে বলার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। বৈঠকে বোয়িং ও এয়ারবাসকে প্রস্তাবের সময়সীমা আরও ২ মাস (সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে) বাড়াতে বলা হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠক সূত্রে আরও জানা যায়, এয়ারবাস ও রোলস-রয়েস টিম ঢাকায় এসে ইঞ্জিন নিয়ে আলোচনা করতে চায়। তবে ইঞ্জিন নির্বাচন কমিটি ইতোমধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ায় প্রতিষ্ঠান দুটিকে এখন ঢাকায় ডাকা হবে না।

বৈঠকে উপস্থিত বিমানের একজন কর্মকর্তা না প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, ‘বোয়িং ও এয়ারবাসের দিক থেকে বিমান কেনার প্রস্তাব আছে। প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে বিমানের চাহিদার বিষয়ে নিয়মিত বৈঠকে আলোচনা হচ্ছে। বিমানের ইঞ্জিন কাদেরটা ভালো হবে, কোনটির সিট ধারণক্ষমতা বেশি, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কাদের বেশি, কোন বিমানের তেল খরচ বেশি হয়- কোনটার কম হয় এ নিয়ে বৈঠকে নিয়মিত আলোচনা হচ্ছে। এ ছাড়া রুট নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হচ্ছে। বিমানের ধারণক্ষমতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর উপর নির্ভর করবে বিমানের লাভ হবে নাকি ক্ষতি। এসব বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা হচ্ছে।’

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, টেকনো ফিন্যান্সিয়াল কমিটির মূল্যায়ন কার্যক্রম বিমান পরিচালনা পর্ষদের কাছে পাঠানো হবে। সেখান থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে যাবে। সরকারের সবুজ সংকেত পেলে তা বাস্তবায়নে বিমান বাংলাদেশ উড়োজাহাজ কেনার প্রক্রিয়া শুরু করবে।

জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) এবিএম রওশন কবির আমাদের সময়কে বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বিমান ক্রয়ের বিষয়ে বোয়িং ও এয়ারবাস কোম্পানি থেকে দুটি আলাদা প্রস্তাব এসেছে। এর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বিমানের জন্য যেটি সুবিধাজনক, সেই কোম্পানি থেকেই কেনা হবে। সবদিক যাচাই-বাছাইয়ের পর সরকারের কাছে প্রস্তাব করা হবে এবং সরকারের সিদ্ধান্তের পরই উড়োজাহাজ কেনা হবে।

এর আগে বিগত সরকারের আমলে বোয়িং ও এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কেনা নিয়ে আলোচনা চলেছিল। শেষ পর্যন্ত বোয়িং প্রস্তাবে না গিয়ে এয়ারবাস কেনার প্রক্রিয়া অনেকটাই এগিয়েছিল বিমান। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর হঠাৎ করেই ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। এটি নিয়ে সরকারের সঙ্গে দফায় দফায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি হলেও কোনো ফলাফল আসেনি। পরে সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ ও গম আমদানির একটি চুক্তি করার পর শুল্ক কমাতে সক্ষম হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নেমে আসে।

প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বাড়াতে হবে বহর ও রুট: বিমানের তথ্য বলছে, সংস্থাটি বর্তমানে ২৫টি গন্তব্যে সেবা দিচ্ছে, যার মধ্যে ১৭টি আন্তর্জাতিক গন্তব্য। ভবিষ্যতে আরও ৪৩টি দেশে গন্তব্য সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশের পরিষেবা চুক্তি রয়েছে। ওইসব আন্তর্জাতিক রুটে পরিষেবা চালু করতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একাধিক ওয়াইড বডি উড়োজাহাজ কেনা প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্বের ১৬টি শহরে ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স তাদের সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।

বিমানের একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ব্যবসার সম্প্রসারণের প্রয়োজনেই নতুন উড়োজাহাজ কেনা প্রয়োজন। বিমানকে প্রতিযোগিতা করতে হয় এমিরেটসের সঙ্গে, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সঙ্গে, কাতারের সঙ্গে। অন্যান্য এয়ারলাইন্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে গেলে নতুন উড়োজাহাজ লাগবেই।

উড়োজাহাজ সংকট: বিমানের বহরের বর্তমানে ২১টি এয়ারক্রাফটের মধ্যে ১৬টি বোয়িং। এর মধ্যে ছয়টি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর এবং ছয়টি ন্যারোবডির বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ রয়েছে। এর বাইরে বিমানের বহরে স্বল্পদূরত্বে রুটে চলাচল উপযোগী পাঁচটি ড্যাশ-৮০০ উড়োজাহাজ রয়েছে। এগুলো প্রায়শই যান্তিক ত্রুটির কারণে গ্রাউন্ডেড হয়। ফলে শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে, যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে। সেই সঙ্গে বিমানের সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে।

২০১০ সালে বিমান একযোগে ১২টি নতুন উড়োজাহাজ সংগ্রহ করেছিল। এরপর আরও দুটি ড্রিমলাইনার ও দুটি ড্যাশ ৮-৪০০ যুক্ত হয় বহরে। তবে গত ১৫ বছরে নতুন কোনো উড়োজাহাজ সংগ্রহ করতে পারেনি রাষ্ট্রীয় এই এয়ারলাইন্স।

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগামী ১০ বছরে দেশের আকাশপথে যাত্রী সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। বর্তমানে বছরে গড়ে ১ কোটি ২৫ লাখ যাত্রী আকাশপথে যাতায়াত করেন। ২০৩৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৫০ লাখে।