রাষ্ট্রপতির আদেশে সাংবিধানিক সংস্কার, ভিন্ন মত বিশেষজ্ঞদের

আসাদুর রহমান
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রাষ্ট্রপতির আদেশে সাংবিধানিক সংস্কার, ভিন্ন মত বিশেষজ্ঞদের

রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক ঐকমত্য হলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মতভেদ রয়েই গেছে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো সাংবিধানিক সংস্কারের ভার পরবর্তী সংসদের ওপর দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল নির্বাচনের আগেই সংস্কারের বাস্তবায়ন চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে সমাধান খুঁজতে আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সর্বশেষ, গতকাল রবিবারের বৈঠকে সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়নের নতুন পথ বের করেছে কমিশন।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, যেসব সংস্কার প্রস্তাব অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া সাংবিধানিক সংস্কারগুলোও রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা চলছে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, সংসদ ছাড়া সংবিধান সংশোধনের সুযোগ নেই। কিন্তু আগামী নির্বাচনের আগেই এটা বাস্তবায়নের পথ বের করতে হবে। সীমাবদ্ধতার মধ্যে সমাধান বের করার চেষ্টা করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে এগুলো বাস্তবায়ন করা যায়। তবে পরবর্তী সংসদ তা গ্রহণ করবে কি না, এটি একটি প্রশ্ন। এ ছাড়া আইনগত চ্যালেঞ্জ এলে টিকে থাকার ঝুঁকিও থেকে যাচ্ছে। অবশ্য নির্বাচনের পরও এসব নিয়ে আর্জির সুযোগ থাকবে। তিনি আরও বলেন, সাংবিধানিক সংস্কারে রাষ্ট্রপতির আদেশটি হবে ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্টের অধীনে, প্রভিশনাল কনস্টিটিউশন করা হয়েছে যেমনভাবে, ঠিক তেমনভাবে। আর এ সংস্কারের আদেশ হবে জুলাই ডিক্লারেশনের অধীনে। এমন আদেশ প্রক্রিয়াকে নতুন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর এটা হবে নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থা। কারণ, লিখিত সংবিধানের অনেক কিছুই তো এখন অকার্যকর।

এই আদেশ ও অধ্যাদেশের মধ্যে পার্থক্য কী- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা হবে এক্সট্রা অর্ডিনারি কনস্টিটিউশনাল ডিসপেনসেশন। সেই ডিসপেনশনের আলোকে এটা করার ক্ষমতা আছে তাদের। এটাকে রেভল্যুশনারি কনস্টিটিউশনিজম বলা যায়।

এদিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন কি গণ-অভ্যুত্থান? নাকি বিপ্লব- এ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। অনেকে বিপ্লব দাবি করলেও সেই অনুসারে কোনো সরকার গঠন হয়নি। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে এবং দেশ পরিচালিত হচ্ছে।

এদিকে রাষ্ট্রপতির আদেশে সাংবিধানিক সংস্কার প্রসঙ্গে প্রবীণ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক আমাদের সময়কে বলেন, বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে এটা সম্ভব নয়। ১০ এপ্রিল প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্ট হয়েছিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেটি করেছিলেন। কিন্তু এ সময়ে আমি-আপনি বা দু-তিনজন বসে বলাটা ভিন্ন বিষয়। এগুলো সংবিধানে নেই। এখন ওনারা (সরকার) যদি মনে করেন, সাংবিধানিক আইন বলে কিছু নেই। আমরা যেটা বলব, সেটাই সংবিধান। তাহলে তো কিছু বলার নেই।

এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন, এক্সট্রা অর্ডিনারি কনস্টিটিউশনাল ডিসপেনসেশন কোনো কিছু জাস্টিফাই করে না। এটা নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের দুটি জাজমেন্ট আছে। সংবিধানের বাইরে, যে কোনো উসিলায় কাজ করা; এটা জায়েজ হবে না। যেটা অসাংবিধানিক, সেটা চিরকালই অসাংবিধানিক। এটা করা যাবে যদি ওনারা বলেন যে, সংবিধান বাতিল। সেটা বাতিল করতে গেলে নতুন সংবিধান হতে ১০ বছর লাগবে। তাহলে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ১০ বছর দেশ কীভাবে চলবে? তিনি আরও বলেন, রেভল্যুশনারি কনস্টিটিউশন হলো আর্মি সরকার এসে বিভিন্ন দেশে বলে- সংবিধান বাদ। মার্শাল ল প্রধান যেটা বলবে, সেটাই আইন।

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রসঙ্গে শাহদীন মালিক বলেন, এটার কোনো সমাধান হবে না। এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই, হবে না। সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে- অধ্যাদেশ দ্বারা সংবিধান সংশোধন করা যাবে না।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত রূপ দলগুলোর কাছে পাঠানোর কথা বলা হলেও পাঠাতে পারেনি ঐকমত্য কমিশন। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, জুলাই সনদকে সংবিধানের যে কোনো ধারার ওপরে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং আদালতে চ্যালেঞ্জ না করার যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, সরকার সেগুলো বাদ দিতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে সাংবিধানিক সংস্কারসহ সব প্রস্তাবের বৈধতা দিতে জামায়াত গণভোটের যে দাবি করেছিল, সরকার সেই প্রস্তাব থেকেও পিছু হটছে। এসব প্রস্তাব বাদ দিয়ে চলতি সপ্তাহেই চূড়ান্ত সনদ দলগুলোর কাছে স্বাক্ষরের জন্য পাঠানো হতে পারে। যদিও এতে থাকছে না সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি। এ প্রক্রিয়ার বিষয়ে সরকারকে পৃথকভাবে জানাবে কমিশন।

এদিকে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। এরপর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার বিষয়ে দলগুলোর কাছে লিখিত মতামত চায় কমিশন এবং শুরু হয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক। প্রসঙ্গত, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হচ্ছে ঐকমত্য কমিশনের বর্ধিত মেয়াদ। এই সময়ের মধ্যেই জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে চায় সরকার।