থমকে আছে বিনিয়োগ
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অর্থনীতির কিছু সূচক ইতিবাচক ধারায় ফিরলেও হতাশা বিরাজ করছে বিনিয়োগে। এর কারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নীতির ধারাবাহিকতা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে নতুন বিনিয়োগ থমকে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব সন্ত্রাস, উচ্চ সুদের হার এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে দেশি ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীরা আস্থার সংকটে আছেন। তারা ‘অপেক্ষা-দেখো’ নীতি গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ দেশি বিনিয়োগ না হলে বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দ্রুত ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা, নীতি-সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সময়মতো জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানো জরুরি। অন্যথায় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
দেশে মহামারী করোনার আঘাত আসার পর থেকেই বিনিয়োগে এক প্রকার ধীরগতি বিরাজ করছিল। এর পর আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর সঙ্গে যোগ হয় গত বছরের জুলাই অস্থিরতার প্রভাব। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা উদ্যোগ ও সংস্কারমূলক পদক্ষেপের ফলে ডলারের বিনিময় হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ অর্থনীতির কিছু সূচকে স্থিতিশীলতা এসেছে। তবে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বিনিয়োগ পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি।
দেশে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির নতুন এলসি এবং বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি থেকে নতুন বিনিয়োগ পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। একই সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির এলসি কমেছে ৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামালের আমদানির ঋণপত্র কমেছে দশমিক ১৫ শতাংশ। এর প্রভাবে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি চলছে। গত জুনে বেসরকারি খাতে ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে আসে, যা ছিল ইতিহাসে সর্বনিম্ন। তবে গত জুলাই মাসে তা সামান্য বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, দেশে বিনিয়োগের জন্য যে পরিবেশ দরকার তা নেই। বিনিয়োগের অন্যতম পূর্বশর্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। হয়তো ধীরে ধীরে আমরা সেদিকে যেতে পারব। নির্বাচন নিয়ে অস্পষ্টতা দূর হওয়ায় রাজনৈতিক দিক থেকে ইতোমধ্যে এই অনিশ্চয়তা কাটতে শুরু করেছে। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়া পর্যন্ত এই অনিশ্চয়তা একেবারে কাটবে না।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে সবার আগে রাজনীতি ঠিক করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যদি থাকে, তা হলে বিনিয়োগ হবে না। আবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি ঠিক না হয়, তা হলে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো অসম্ভব। এর মধ্যে ঋণের সুদের হার অনেক বেড়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা আছে। তাই দেশকে এগিয়ে নিতে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের উৎপাদনে : দেশের বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের উৎপাদন পরিস্থিতি নিয়ে মাসভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রকাশিত শিল্পোৎপাদন সূচকে ৫২৬টি বৃহৎ শিল্পের উৎপাদনের তথ্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এতে দেখা যায়, চলতি বছর জুনের শেষে দেশের বৃহৎ শিল্পের উৎপাদন সূচক দাঁড়িয়েছে ২০২ দশমিক ৩৯ পয়েন্টে। গত বছরের জুলাইয়ে এ সূচক ছিল ২০৩ দশমিক ৩৩ পয়েন্ট।
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণেও অগ্রগতি কম : দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলেও কাক্সিক্ষত হারে তা বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সম্পর্কিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআই এসেছে ১৭১ কোটি ২০ লাখ ডলার। এটি আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০ দশমিক ১৪ শতাংশ বেশি। এটি সাময়িক হিসাব। চূড়ান্ত হিসাবে কম-বেশি হতে পারে। অন্যদিকে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সমন্বয় কমিটির পঞ্চম সভায় দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১২৫ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ ৪৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ ছাড়া স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব ৭০ কোটি ডলার এবং যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব ৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারের। মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বতী সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ বিদেশি বিনিয়োগ টানতে সহায়ক হচ্ছে। বিশেষ করে ডলারের বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ও রিজার্ভের বৃদ্ধি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ভূমিকা রাখছে।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার আমাদের সময়কে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আমাদের দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। পটপরিবর্তনের পর বিদেশি বিনিয়োগে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তা অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে কাক্সিক্ষত বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে অনেক দেশের তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। বিদেশিদের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে বেশ কয়েকটি বাধা রয়েছে। রাজস্বনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা সব সময় ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারি না। ব?্যবসার লভ্যাংশ, কারিগরি সহয়োগিতা ফি ও রয়্যালিটি প্রত্যাবাসনে জটিলতা আছে। তিনি বলেন, ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘সমুদ্রে যথেষ্ট মাছ আছে, আমাদের মাছ ধরা শিখতে হবে।’ বিশ্বব্যাপী মোট ১.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এফডিআই আছে, যার প্রায় অর্ধেক এশিয়ায় বিনিয়োগ করা হয়েছে। এমনকি বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন অনুসারে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যেও এফডিআই বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে ২০২৪ সালে আমাদের এফডিআই কমেছে।
নিশ্চিত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া এখনই কেউ বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এমন প্রত্যাশা পুরোপুরি কাল্পনিক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। গত মাসে সিপিডির এক অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা থাকলেও দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনিশ্চিত থাকার কারণে বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রবাহ অচিরেই বাড়ার সম্ভাবনা কম। বিনিয়োগ পাইপলাইনে ইতিবাচক কিছু সাইন দেখা যাচ্ছে; কিন্তু সময় লাগবে। সামনে নির্বাচন থাকায় বড় কোনো বিনিয়োগকারী বা বিদেশি বিনিয়োগকারী এই মুহূর্তে আসতে চাইবেন না।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
বিদেশি বিনিয়োগ টানতে গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫-এর আয়োজন করে বিডা ও বেজা। এর মাধ্যমে দেশের বিনিয়োগ পরিবেশের সম্ভাবনা বিশ্বজুড়ে তুলে ধরা হয়েছে। এই সম্মেলনে ৫০টি দেশ থেকে ৪১৫ জন বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করেন। এই আয়োজন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে বলে আয়োজকরা জানান। এ ছাড়া তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ মোট ১৯টি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। এ জন্য সংস্থাটি একটি হিটম্যাপ তথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সেই সঙ্গে বিডা নতুনভাবে ডিজাইন করা ওয়েবসাইট চালু করেছে, যেখানে বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, নীতিমালা এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার ফোকাল পয়েন্ট সম্পর্কিত হালনাগাদ তথ্য এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিডা ওয়ান-স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) পোর্টালেরও হালনাগাদ সংস্করণ চালু করেছে। এর উদ্দেশ্য হলো দেশি ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের জন্য সেবার গুণগতমান বৃদ্ধি করা। কিছু ক্ষেত্রে বিদেশিদের জন্য করছাড়ের শর্তও শিথিল করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) ও হাইটেক পার্কে বিদেশে ব্যবহার হয়- এমন যন্ত্রপাতি এনে উৎপাদন কাজে ব্যবহার করলেও করছাড় বা অবকাশের সুবিধা পাবেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এতদিন এই সুবিধা ছিল না। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এসব পদক্ষেপের ফল পেতে সময় লাগবে।