মাত্র ৭ দিনে লুট হয় ৮০ শতাংশ পাথর
সিলেটের পর্যটন স্পটের সাদা পাথরের ৮০ শতাংশই লুট হয়ে গেছে মাত্র ৭ দিনে (৫ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট)। এ সময়কালে পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ছিল নীরব। বাধা দিতে গেলে মবের শিকার হতে হবে- এমন আশঙ্কা থেকেই ওই সময় কেউ লুটেরাদের বাধা দিতে যায়নি।
দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা সাদা পাথর লুটকা-ের জেরে সরেজমিন পরিদর্শনের পর একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। প্রতিবেদনে উপরোল্লিখিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
স্থানীয় জনগণসহ উপজেলায় দায়িত্বে থাকা সরকারের সব সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় বা আলাপ করে এমন তথ্য পেয়েছে কমিশনের পরিদর্শন টিম। তাদের করা প্রতিবেদন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে পাঠানো হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। প্রতিবেদনে সিলেটের পর্যটন এলাকার পাথর রক্ষা করতে ১২টি সুপারিশও করা হয়েছে। পরিদর্শন টিমে ছিলেন কমিশনের পরিচালক খোকন কান্তি সাহা, সহকারী প্রধান সাকিব মাহমুদ ও মো. তৌহিদুল আজিজ।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, পাথর লুটের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত ছিলেন। তবে লুটকৃত পাথরের প্রকৃত পরিমাণ কোনো সংস্থাই জানে না। এমনকি বিগত বছরগুলোয় কী পরিমাণ পাথর এসে জমা হয়েছে, এমন কোনো তথ্যও নেই কোনো সংস্থার কাছে। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, খনিজ সম্পদ ব্যুরোর নির্দেশনার কারণে তারা সংশ্লিষ্ট এলাকায় কোনো অভিযানও চালাতে পারেনি। অন্যদিকে ওই এলাকাগুলোতে খনিজ সম্পদ ব্যুরোর নিজস্ব কোনো নজরদারিও ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের উপস্থিতিতে ধলাই নদী সংলগ্ন ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে নদীরক্ষা কমিশনের পরিদর্শন টিম। তারা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার বলেন, মূলত ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে ভোলাগঞ্জ থেকে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। তখন উপজেলা প্রশাসন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করে। তবে চলতি বছরের ৫ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট ৭ দিনেই প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর লুট হয়ে যায়। এ সময় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের জন্য প্রায় এক হাজার নৌকাযোগে কয়েক হাজার লোক মিলে এক ধরনের ‘মব সৃষ্টি করে’। তিনি আরও জানান, ওই সময় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর উৎসমুখ পর্যন্ত পাথর উত্তোলনকারীরা পৌঁছে যায় এবং পাথর লুটের সুযোগ পায়। এ সময় পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে এবং যথাসময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা না পাওয়ায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন প্রশাসনের একার পক্ষে ঠেকানো যায়নি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানান, গত ১৭ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়েছে এবং প্রায় দেড় লাখ ঘনফুট পাথর ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কমিশনকে তিনি জানান, পাথর উত্তোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য, একজন ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পরস্পরের যোগসাজশে জড়িত ছিলেন। ওই এলাকায় রেলওয়ের সদস্যদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। নিরাপত্তাহীনতার কারণে রেলওয়ের ক্যাম্পটি অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়। সে সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালী অসাধু চক্র, সুযোগসন্ধানী মহল অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও পাচার করে। তিনি বলেন, ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটন এলাকা সংলগ্ন স্থানে পাথর কোয়ারি থাকলেও ২০১৮ সালের পর থেকে কোয়ারি ইজারা বন্ধ রয়েছে। অবৈধ পাথর উত্তোলনের ঘটনার পর বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর কোনো প্রতিনিধি বা টিম উক্ত এলাকা ১৭ আগস্ট পর্যন্ত পরিদর্শন করেনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে প্রশাসনের সহযোগিতায় অভিযান পরিচালনা করত। তবে ৬ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত তারা কোনো অভিযানে যাননি। এ ছাড়া ৯ আগস্ট খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো থেকে সিলেটের পরিবেশ অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, আইন অনুযায়ী খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ এলাকায় কোনো অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হলে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সে কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক উদ্যোগী হয়ে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়নি।
কমিশনের প্রতিনিধি টিমকে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি জানিয়েছেন, পুলিশের পর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে ৬ আগস্ট থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে গিয়ে পুলিশ ও বিজিবি কয়েকবার লুটেরাদের দ্বারা আক্রান্তও হয়েছে।
পরিদর্শন টিমের পর্যবেক্ষণ : পরিদর্শন টিম বলছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে পাথর ও বালু উত্তোলন করা হলেও স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য মতে, মূলত চলতি বছরের ৫-১১ আগস্ট প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন ও পাচার করা হয়। প্রশাসন ৫ থেকে ১১ আগস্ট সময়কালে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে জেলা-উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশসহ (বিজিবি) বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক সমন্বিতভাবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পাথর লুটের স্থানে যৌথবাহিনীর ২৪ ঘণ্টা টহল দেওয়ার কথা থাকলেও সরেজমিন পরিদর্শনকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি পর্যটন এলাকায় ট্যুরিস্ট পুলিশের উপস্থিতিও ছিল না। স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারির অভাবেই সুযোগসন্ধানী মহল পাথর লুট করেছে। এ ছাড়া কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায় দুই শতাধিক স্টোন ক্রাশার থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কী পরিমাণ উত্তোলিত পাথর ক্রাশ করা হয়েছে, তার হালনাগাদ তথ্য নেই প্রশাসনের কাছে। এ ছাড়া কী পরিমাণ পাথর এসেছে, অবৈধভাবে উত্তোলন-বিক্রি হয়েছে, পরিবেশের কী ক্ষতি হয়েছে- এসব তথ্য কারও কাছেই নেই। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, সাড়ে ৪ লাখ ফুট পাথর উদ্ধার করে স্থাপন করা হয়েছে। সেটা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে কি না, এরও সদুত্তর পায়নি কমিটি।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী পাথর কোয়ারি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের এখতিয়ার খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরে?ার। তবে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত পাথর লুটের (০৫-১১ আগস্ট) ঘটনায় ব্যুরে?া কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। এ ছাড়া পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ধলাই নদীর নৌপথে পুলিশ কিংবা অন্য কোনো বাহিনীর চেকপোস্টও নেই। ফলে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও পাচার করতে পেরেছে।
কমিটির সুপারিশ : ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটন এলাকায় নিরাপত্তা বলয় (সিকিউরিটি ফেন্সিং) করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া অবৈধ পাথর উত্তোলনের তদন্ত চলাকালে পর্যটন এলাকায় পর্যটকদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। সাদা পাথর এলাকায় পরিবেশবান্ধব ওয়াকওয়ে তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে। উক্ত এলাকার পরিবেশ সংরক্ষণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। সাদা পাথর অবৈধভাবে উত্তোলনের কারণে কি পরিমাণ পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া পাথর লুটে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম বাড়াতে বলা হয়েছে। ভোলাগঞ্জের ধলাই নদী ও এর আশপাশের এলাকায় ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত কি পরিমাণ পাথর মজুদ ছিল এবং কী পরিমাণ পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন করা হয়েছে তা নিরূপণ করে কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতি বছর তথ্য সংরক্ষণ ও নিয়মিত মনিটরিং করা, স্টোন ক্রাশার প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স বৈধ কি না, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করতে হবে। ধলাই নদীতে নৌ চলাচল সীমিত রাখারও সুপারিশ করা হয়েছে।