সমস্যার বোঝা নিয়ে ঢিমিয়ে চলছে রেল
রাষ্ট্রায়ত্ত যাত্রীবাহী ট্রেনে চাহিদার তুলনায় আসন কম। তাই যাত্রীরা টিকিট না পাওয়ার অভিযোগ করেন। রেলে লোকোমোটিভ ও কোচ সংকট বহুদিনের। বিদ্যমান ইঞ্জিন ও বগির বেশির ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ। অপ্রতুল মেরামতের ব্যবস্থা। কারখানায় একদিকে দক্ষ জনবলের অভাব, অন্যদিকে বরাদ্দের ঘাটতি। নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ। বহুদিন ধরেই চলছে এমন দুরবস্থা। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে রেলের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এক লাখ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। এর বেশির ভাগই ছিল বিদেশি ঋণ। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা গেছে, রেলের পরিচালন খাতে প্রতিবছর কমবেশি ১০ শতাংশ হারে ব্যয় বাড়ছে। সে তুলনায় আয় বাড়ছে গড়ে ৫ শতাংশের কম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জনপ্রিয় রুটে ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নেওয়া স্টপেজ ও রুট বন্ধ করলে লোকসান কিছুটা কমানো সম্ভব। রেলওয়ে এক টাকা আয় করতে গিয়ে খরচ করছে আড়াই টাকার বেশি। ট্রেনের লাইনচ্যুতি ও বিকল হয়ে পড়ার ঘটনা এড়াতে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। বর্তমানে মিটারগেজ লোকোমোটিভের সংকট রয়েছে। প্রায় ৬০-৬৫ শতাংশ মিটারগেজের প্রাপ্যতা আর ব্রডগেজে মেলে ৭০-৭৫%। ১৫৩টি মিটারগেজের মধ্যে ১০৩টি এবং ব্রডগেজ লোকোমোটিভের হোল্ডিং ১২৮টির মধ্যে ৩২টির আয়ুষ্কাল পার। দীর্ঘদিনের পুরনো লোকোমোটিভের কর্মদক্ষতার অভাব। পথে প্রায় বিকল হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রাংশের প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হয়। পুরনো ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না। এ কারণে ভারী মেরামত (জিওএইচ) শিডিউল বন্ধ রয়েছে। মেরামতের কারখানাগুলো বেশ পুরনো। সেখানকার মেশিন বহু আগের। রেলবহরে থাকা ৩০০০ ও ৬৬০০ সিরিজের লোকোমোটিভ অত্যাধুনিক। কিন্তু এ জন্য দক্ষ জনবল ও যন্ত্রাংশ নেই। যান্ত্রিক বিভাগে ১৪২৮টি পদের মধ্যে ৯৪৮টি শূন্য। এতে মেরামত কার্যক্রম সুষ্ঠু হচ্ছে না। পিএসসিতে প্রশাসনিক জটিলতা থাকায় ‘এসএই’ নিয়োগের কার্যক্রম বিলম্বিত।
ট্রেন পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দ জরুরি। যথাসময়ে দরপত্র আহ্বান, মালমাল সংগ্রহ ও মেরামত কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ট্রেনের জন্য দরকারি এইএসডি অয়েলের বাজেট আগের তুলনায় কমে গেছে। বাজেট ঘাটতির কারণে তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বকেয়া বিল পরিশোধের আগিদ দেওয়া হচ্ছে। সরঞ্জাম বিভাগ থেকে বিভিন্ন কারখানায় যথাসময়ে মালামাল না পাওয়ার অভিযোগ আছে। ইমপ্রেস্ট ফেইলিওর
ও স্টক আইটেম যথাসময়ে না পাওয়ার কারণে মেরামত বিঘিœত হচ্ছে বলে দাবি কিছু মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তার। এ ছাড়া বিদেশ থেকে ডিজেল স্পেয়ার্স সংগ্রহের ক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বান, মূল্যায়নে দীর্ঘসূত্রতা, দরপত্র অনুমোদনের জটিলতার কথাও বলছেন কেউ কেউ।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
বাংলাদেশ রেলওয়ে এক সময় ছিল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাণশক্তি। শহর থেকে শহরে, বন্দর থেকে শিল্পাঞ্চলে, কৃষিপণ্য থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কনটেইনার ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে রেল ছিল নির্ভরযোগ্য বাহন। কিন্তু আজ এই প্রতিষ্ঠান গভীর সংকটে নিমজ্জিত, যার মূলে রয়েছে লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিনের ঘাটতি। তবে এটি শুধুমাত্র একটি যান্ত্রিক সমস্যা নয়। এর পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক অদূরদর্শিতা, নীতিনির্ধারণী ব্যর্থতাও।
বর্তমানে অধিকাংশ আন্তঃনগর ট্রেন ১০ থেকে ১৪টি কোচ দিয়ে পরিচালনা করা হয়। এর ফলে ইঞ্জিন ও লোকবলের সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এ জন্য প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনে ১৮ থেকে ২০টি বগি নিয়ে চলাচল নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এতে জ্বালানি খরচ না বাড়িয়ে আয় বাড়ানো সম্ভব। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর চলাচলের পথ মূল্যায়ন করা দরকার। অর্থাৎ যেসব পথে যাত্রী কম, সেই পথ থেকে ট্রেন কমিয়ে অন্য পথে চালানো।
দেশের মোট পণ্য পরিবহনের উল্লেখযোগ্য অংশ রেলের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে কনটেইনার পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ট্রেন। তেল, গম, সারসহ বিভিন্ন কাঁচামাল দেশের ভেতরে দ্রুত পরিবহনের জন্য রেল অপরিহার্য। প্রতিদিন কয়েক লাখ যাত্রী রেলের ওপর নির্ভরশীল। এসব কিছুর জন্য লোকোমোটিভ হচ্ছে রেলওয়ের প্রাণ। ইঞ্জিন ছাড়া কোচ ও ওয়াগন কেবল লোহা-ইস্পাতের বোঝা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে মোট লোকোমোটিভ ১৪০টি। এর মধ্যে সচল ৮০টি ও অকেজো ৬০টি। বাস্তবে দৈনিক প্রয়োজন ১০০টি; ঘাটতি ২০টি। প্রতিদিন ৫-৭টি ইঞ্জিন হঠাৎ অকেজো হয়ে যায়, ফলে সচল সংখ্যা আরও কমে আসে। জরুরি মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় স্পেয়ার পার্টস নেই। দীর্ঘসূত্রতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে মেরামতযোগ্য ইঞ্জিন মাসের পর মাস অকেজো পড়ে থাকে। তাই নতুন প্রকল্প নেওয়া জরুরি। সর্বশেষ খবর, ৯২৭ কোটি টাকায় ২০০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ কেনার একটি প্রকল্প ৯ বছর পর বাতিল করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চীনের একটি কোম্পানি থেকে কোচগুলো কেনার এই প্রকল্প বাতিল হয়েছে ঋণের শর্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায়। এবার এডিবির অর্থায়নে ৩২৮ কোটি ১৫ লাখ ১৬ হাজার টাকার আরেকটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ইঞ্জিন সংকটের কারণে ইতোমধ্যে কনটেইনার পরিবহন কমেছে ৫০ হাজার টিইইউএস, আয় কমেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। তেল, খাদ্য ও অন্যান্য মালামাল পরিবহনে ক্ষতি প্রায় ২৫ কোটি টাকা। মেইল ও লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকার কারণে যাত্রী ও লাগেজ ভ্যানে আয় কমেছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিবছর অন্তত ১০০ কোটি টাকা আয় কমছে, এটা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশাল ক্ষতি।
এ বিষয়ে রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালক আফজাল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, রেলে যাত্রী চাহিদা পূরণে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নতুন লোকোমোটিভ ও যন্ত্রাংশ সংগ্রহ, কারখানা আধুনিকায়ন ইত্যাদি নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর ফলে মেরামতের গতি বাড়বে।
রেল বলছে, ভারতীয় রেলে এক দশক ধরে অপারেটিং রেশিও ৯৫-৯৮ শতাংশের ঘরে। ফলে সে দেশে রেলওয়ে লাভজনক অবস্থায় আছে। রেলের সবচেয়ে ভালো অপারেটিং রেশিও ছিল ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে, ৯৫ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে প্রতি ১ টাকা আয় করতে রেলের ব্যয় হয়েছিল ৯৫ দশমিক ৯ পয়সা। এর পর থেকে রেলের অপারেটিং রেশিও কেবল বেড়েই চলেছে। এখন ১ টাকা আয় করতে ব্যয় হয় ২ টাকা ৫৮ পয়সা। কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির আয় ও ব্যয়ের অনুপাত ‘অপারেটিং রেশিও’ দিয়ে নির্ধারণ করা যায়। এর মাধ্যমে রেলব্যবস্থা কতটা দক্ষ ও লাভজনক তা বোঝা যায়। অপারেটিং রেশিও মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়ের মোট ব্যয়কে মোট আয় দিয়ে ভাগ করা। অপারেটিং রেশিও যত বেশি হবে, ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালন দক্ষতা তত দুর্বল হিসেবে গণ্য করা হয়। ব্যয় কমাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে। জনগণের ওপর চাপ না বাড়িয়ে রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় কমানো, লোকসানি রুটে ট্রেনের চলাচল কমিয়ে লাভজনক রুটে বাড়ানো; রেলের বিপুল ভূসম্পত্তি ইজারা (লিজ) দিয়ে আয় করার ওপর জোর দিতে চায় রেলওয়ে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম