পাঁচ বছরে সংঘাত হয়েছে ২০ বার

সামান্যতেই শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলে স্থানীয়রা ।। গ্রামবাসীদের অশিক্ষিত বলে অবজ্ঞা করে শিক্ষার্থীরা

রায়হান উদ্দিন, চট্টগ্রাম
০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
পাঁচ বছরে সংঘাত হয়েছে ২০ বার

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। গত পাঁচ বছরে এই দুই পক্ষের মধ্যে অন্তত ২০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। পরিবহন ভাড়া, বাসা ভাড়া কিংবা সাধারণ কথা কাটাকাটির মতো বিষয় থেকেও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা। সশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং ঘটনার পর বিচারহীনতার সংস্কৃতিই বারবার এসব সংঘর্ষের জন্ম দিচ্ছে। আর স্থানীয়দের সঙ্গে বারবার সহিংসতা পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে সংকটের মুখে ফেলেছে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে আশপাশের এলাকাজুড়ে স্থানীয়দের একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। বিশেষ করে শাটল ট্রেন স্টেশন সংলগ্ন সড়কপথ, অটোরিকশা চলাচল, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও আবাসিক বাসা ভাড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ওপর দাপট দেখান তারা। অভিযোগ রয়েছে, সামান্য কিছু হলেই স্থানীয়রা শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলে। স্থানীয়দের দাবি, শিক্ষার্থীরাও জোবরা গ্রামবাসীকে মূল্যায়ন করে না। তারা অশিক্ষিত বলে অবজ্ঞা করে।

চবি শিক্ষার্থী আশফাকুল হক বলেন, প্রতিবার ঘটনা ঘটে, তদন্ত হয়, কিন্তু কার্যকর কোনো শাস্তি বা ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। এতে অপরাধীরা উৎসাহিত হয়। শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের এভাবে মুখোমুখি হয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না।

স্থানীয় বাসিন্দা পারভেজ উদ্দিন ইকবাল বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব নেই। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ায় এই গ্রাম আজ উন্নত। আমরা তাদের হামলা কিংবা মারধর কেন করব? শিক্ষার্থীরা তরুণ হওয়ায় অল্প কিছুতে তারা ঘটনা বড় করে ফেলেন। পারস্পরিক সহমর্মিতা থাকলে এমন হতো না।

দ্বন্দ্বের কারণ

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের মধ্যে বারংবার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে কিছু সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকা অর্থাৎ জোবরা গ্রাম অনেকটা শিক্ষার্থীনির্ভর। এখানকার বাসা ভাড়া, খাবার, পরিবহন ইত্যাদি সব খাতে শিক্ষার্থীরাই বড় ভোক্তা। স্থানীয়দের একটি অংশ এই চাহিদার সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করতে চায়। শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত ভাড়া বা অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুললে স্থানীয়দের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। সামান্য কিছু হলেই স্থানীয়রা শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলে।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের সড়ক, রিকশা স্ট্যান্ড, দোকান- এসবের ওপর স্থানীয় চক্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত। শহর বা ভিন্ন জেলা থেকে আগত শিক্ষার্থীদের ভাষা, চালচলন অনেক সময় স্থানীয়দের থেকে ভিন্ন হয়। অনেক স্থানীয়ই শিক্ষার্থীদের অস্থায়ী অতিথি মনে করে, ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠে না। প্রায় সময় প্রশাসন নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয় অথবা ঘটনার পর ‘দেখছি’ বলা ছাড়া তৎপরতা দেখায় না। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কিছু সংঘর্ষের পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক চক্রেরও ভূমিকা থাকে। কোনো কোনো সময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পক্ষগুলোও এই দ্বন্দ্বে সক্রিয় বা উসকানিদাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করে।

স্থানীয় বাসিন্দা পারভেজ উদ্দিন ইকবাল বলেন, জোবরা গ্রামবাসীর জমিতে এই বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা গ্রামবাসীকে মূল্যায়ন করে না এবং অশিক্ষিত বলে অবজ্ঞা করে।

পাঁচ বছরে ২০ সংঘর্ষ-হামলা

গত পাঁচ বছরে স্থানীয় ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তত ২০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গতকাল ক্যাম্পাসসহ আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এর আগে গত ৮ আগস্ট সকালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়রা হামলা চালায়। ওই ঘটনায় একজন গুরুতরসহ তিন শিক্ষার্থী আহত হন। ঘটনার পর প্রশাসনের কেউ না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষার্থীরা মূল ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ করে। গত ১৫ এপ্রিল সুলতান আরেফিন নামে চবির এক শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়। স্থানীয় এক সিএনজি চালকের সঙ্গে বাগ্বিত-ার এক পর্যায়ে স্থানীয় কয়েকজন যুবক মিলে তার ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনায় ১১ ঘণ্টা চবির মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা।

এ ছাড়া গত বছরের ২১ অক্টোবর চবির রেলস্টেশন সংলগ্ন দোকান দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় স্থানীয়রা। এ হামলায় অন্তত চারজন শিক্ষার্থী আহত হন। স্থানীয় যুবলীগ নেতার ইন্ধনে ওই হামলা হয় বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে ১২ জুন রাতে সিএনজি ভাড়া বেশি নেওয়ার প্রতিবাদ করায় দুই শিক্ষার্থীকে মারধর করে চালকরা। এ ঘটনায় স্থানীয়দের সঙ্গে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে প্রশাসন শান্ত করে। ২০২৩ সালের আগস্টে কটেজ থেকে এক শিক্ষার্থীকে বের করা নিয়ে মুখোমুখি হয় শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা। এভাবে গত পাঁচ বছরে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে ২০টি হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

সার্বিক বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সচেতন নাগরিক সমাজ জানায়, শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে ঠুনকো অজুহাতে এই হামলা-সংঘর্ষ কাম্য নয়। এটা শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত করছে। শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি।