জিয়াউর রহমানের সততার আলোকেই রাজনীতি করতে হবে বিএনপির
আজ ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দিবসটি সামনে রেখে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে কথা বলেছে আমাদের সময়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নির্বাহী সম্পাদক এহ্সান মাহমুদ
আমাদের সময় : ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ সময়ে এসে রাজনৈতিক দল হিসেবে আপনি বিএনপিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর : আমি বিএনপির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমার মূল্যায়ন আর আপনার মূল্যায়ন এক হবে না। আমি মনে করি বিএনপি শুধু বাংলাদেশে নয়, এ উপমহাদেশে একটা উল্লেখযোগ্য উদারপন্থি রাজনৈতিক দল, যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে, করছে। আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতাই বাংলাদেশে প্রথম বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেছিলেন। পরবর্তীকালে আমাদের দলের নেত্রী দেশে গণতন্ত্রের সরাসরি প্রবর্তন করেছিলেন এবং ইউনিক সিস্টেম তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সংবিধান করেছিলেন। বিএনপির সফলতা আরও অনেক রাজনৈতিক দলের চেয়েও অনেক বেশি।
এবার আসুন অর্থনীতিতে। দেশে ১৯৭২ সাল থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত ভ্রান্ত একটা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে লুটপাট চলেছিল। এরপর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পর একটা উদার অর্থনীতি ব্যবস্থা চালু করেন। ফলে দেশের অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়; বেসরকারি বিনিয়োগ, দেশের বাইরের বিনিয়োগ, মূল্য কাঠামো তৈরি করা- সব মিলিয়ে দেশে নতুন এক উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। এসব বিষয় বিএনপিকে নিঃসন্দেহে অনন্য একটি দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমিসহ বিএনপির অনেক নেতাই মনে করেন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব মারা যাওয়ার সময় যদি জিয়াউর রহমানও মারা যেতেন, তাহলে বাংলাদেশের আজকের অবস্থা হতো লাইবেরিয়া বা আফগানিস্তানের মতো। জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক একটা পরিবর্তনের সূচনা করেন।
বিএনপি হলো সেই দল, যে দল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রগুলো তৈরি করার পাশাপাশি সমৃদ্ধ অর্থনীতির পথও সুগম করেছে। সেদিক থেকে মনে করি, বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
আমাদের সময় : দেড় দশকেরও বেশি সময় বিরোধী দলে ছিল বিএনপি। এ সময়কালে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়েছে দলটিকে। দেশে এখন নতুন একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। অনেকের মতে- অবাধ, সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যাবে বিএনপি। সেক্ষেত্রে বিএনপির সামনে এখন কী চ্যালেঞ্জ?
মির্জা আলমগীর : নির্বাচন নিয়ে চক্রান্ত হচ্ছে। সেই চক্রান্ত কঠোরভাবে মোকাবিলা করা এবং প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়ে, নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানে সার্বিক সহযোগিতা করা বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন যেন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়, সে লক্ষ্যে শক্তিশালী জনমত তৈরি করতে হবে আমাদের। এক কথায়, একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আমাদের সময় : অন্তর্বর্তী সরকারের গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দেশে এখন দুটি বিষয়ে আলোচনা আছে। একটা হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অন্যটা হচ্ছে, জাতীয় সরকারের গুঞ্জন। অন্তর্বর্তী সরকারই নির্বাচনকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হবে কিনা, এ নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মির্জা আলমগীর : এটা স্রেফ গুঞ্জনই। কারণ আমরা এ গুঞ্জনের কোনো ভিত্তি খুঁজে পাই না।
আমাদের সময় : অন্তর্বর্তী সরকারই আগামী নির্বাচন সম্পূর্ণ করবে নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার?
মির্জা আলমগীর : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টা এ মুহূর্তে আসবে না। এটা সংস্কারের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা পরবর্তীকালের নির্বাচনে আসতে পারে। সুতরাং দ্য বাস ফর গো...
আমাদের সময় : বিদ্যমান প্রশাসনিক অবস্থা এবং পুলিশ প্রশাসনের ওপর আপনারা আস্থা রাখতে পারছেন কি?
মির্জা আলমগীর : প্রশাসনের ওপর আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। প্রশাসন নির্বাচন করতে সহযোগিতা করে। নির্বাচনের মূল বিষয়টাতে জনগণ সম্পৃক্ত। জনগণ যখন ভোট দিতে আসবে, তখন প্রশাসন বলুন আর পুলিশ বলুন, তাদের কিন্তু জনগণকে সহযোগিতা করতেই হবে। সময় ও পরিস্থিতি বুঝে ভোল্ট পাল্টায় প্রশাসন। যখন যেভাবে সুবিধা হয়, সেটাই তারা করে। এক্ষেত্রে তাদের অন্য কোনো সুযোগ নেই। প্রশাসনে যদি রাজনীতিকরণ করা না হয়, তাহলে অবশ্যই নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে।
আমাদের সময় : বিএনপি মাঠে কর্মসূচি দিচ্ছে, কাউন্সিলও হচ্ছে। কিন্তু অনেকেই বলছেন, তৃণমূলের কর্মীদের আচরণে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে, ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও।
মির্জা আলমগীর : ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত বিএনপির কর্মীরা ঘর থেকে বের হতে পারতেন না কিংবা ঘরে ঢুকতে পারতেন না। তখন রাস্তায় নামা খুবই কঠিন ছিল। এর পরও বিএনপির কর্মীরা ১৫ বছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে গেছেন। ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এটা ছেলে খেলা নয়। বিশেষ করে, ১৭শ মানুষ গুম হয়ে গেছে। প্রায় ২০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সেই সূত্রে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন মুক্ত পরিবেশে অনেক ভালোভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। সে কাজ তারা করছেনও। মূলত, বিএনপির বিরুদ্ধে নানা রকম অপপ্রচার চলছে। সেটা মোকাবিলা করেই কিন্তু বিএনপি এগিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের সময় : বিএনপির অনেক নেতা বলছেন, গণমাধ্যমে বিএনপির ইতিবাচক সংবাদের চেয়ে নেতিবাচক সংবাদ বেশি আসছে...
মির্জা আলমগীর : এটা বোধ করি বাংলাদেশের মিডিয়ার ক্যারেক্টার। মিডিয়া এখন ব্যবসায়ীদের হাতে, তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নেতিবাচক সংবাদকে তারা হয়তো ব্যবসায়িক লাভের দৃষ্টিতে দেখে। উপরন্তু মিডিয়ার আচরণ সব সময় নিরপেক্ষ থাকছে না। সম্প্রতি তাদের একটা চোখ থাকছে অ্যান্টি-বিএনপি প্রচারণার দিকে। আমার কাছে এমনটা মনে হয়। সুতরাং আমি আশা করি না যে, একদম নিরপেক্ষ হিসেবে কাজ করবে। তবে হ্যাঁ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়।
আমাদের সময় : আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি যে, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি চুক্তি করেছে। বাংলাদেশকে তারা আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। বিশেষ করে এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নানা রকমের গুজব ছড়ানো রোধে। বিএনপি দলগতভাবে এটাকে কীভাবে মোকাবিলা করবে? আপনাদের কোনো প্রস্তুতি আছে কি?
মির্জা আলমগীর : আমাদের প্রস্তুতি আছে। বিএনপি ইতোমধ্যে একটা সেল তৈরি করেছে। তারা কাজ করছে। সামনে আরও অগ্রসর হবে। এ বিষয়ে দক্ষ ও যোগ্য লোকদের সম্পৃক্ত করা হবে। দল থেকে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমাদের সময় : সম্প্রতি ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরকে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়েছে। তার নাকের হাড় ও মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। সরকারের তরফে বিচার বিভাগীয় তদন্তের কথা বলা হচ্ছে। নূর তো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আপনাদের সহযোদ্ধা ছিলেন। তাই তার ওপর হামলার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
মির্জা আলমগীর : আমরা সঙ্গে সঙ্গেই কল দিয়েছি, তার খবর নিয়েছি এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছি; নূরের প্রতি আমাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছি; সহমর্মিতা জানিয়েছি। আমরা মনে করি, এ ঘটনা পরিকল্পিতভাবে করানো হয়েছে যেন নির্বাচন ব্যাহত করা যায়, বিলম্বিত করা যায়।
আমাদের সময় : আজ (গতকাল রবিবার) প্রধান উপদেষ্টা তিনটি দলকে ডেকেছেন। যখনই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়, তখনই প্রধান উপদেষ্টা দলগুলোকে ডাকেন, কথা বলেন। আপনি বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মির্জা আলমগীর : এটা অরাজনৈতিক সরকার। কোনো সংকট সৃষ্টি হলেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই সরকারের পরামর্শ করাটাকে আমি খুবই ইতিবাচকভাবে দেখছি। এটা নিঃসন্দেহে সরকারের দূরদৃষ্টির পরিচয় বহন করে।
আমাদের সময় : বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মহাসচিব হিসেবে দলের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর প্রতি আপনার বার্তা কী?
মির্জা আলমগীর : বিএনপির যে ঐতিহ্য, সেটি রক্ষা করতে হবে। জনগণের প্রতি বিএনপির একটা কমিটমেন্ট আছে। জনগণের কল্যাণে কাজ করতে হবে আমাদের। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের যে সততা, সেই সততার আলোকে রাজনীতি করতে হবে। গণতন্ত্রের প্রতি বিএনপির বর্তমান চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার যে আপসহীনতা, সেটাকে রক্ষা করতে হবে নেতাকর্মীদের।
বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা, কর্মদক্ষতা ও দেশপ্রেম তার, সেসব অনুধাবন করে লক্ষ্য ঠিক রেখে কাজ করতে হবে আমাদের। জনগণের ভালোবাসার জন্য তৈরি করতে হবে বিএনপিকে এবং সেই ভালোবাসা অটুট রাখতে হবে। বিএনপিকে অবশ্যই আগামী দিনে সরকার গঠনে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে তৈরি করতে হবে আমাদের।
আমাদের সময় : আপনাকে ধন্যবাদ।
মির্জা আলমগীর : আমাদের সময়ের জন্য শুভকামনা।