দখল পুনঃদখলে অস্তিত্ব সংকটে রামচন্দ্রপুর খাল

শাহজাহান মোল্লা
৩১ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
দখল পুনঃদখলে অস্তিত্ব সংকটে রামচন্দ্রপুর খাল

কাগজে খাল থাকলেও বাস্তবে সেখানে বসতভিটা, বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বাজার, ট্রাক স্ট্যান্ড, পরিত্যক্ত স্থাপনা ও গরুর খামার। বাকি যেটুকু খাল সেটুকু পলিথিন এবং বর্জ্য দিয়ে ভরাট। ফলে বাস্তবে খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুরূহ। বলছি ঢাকার মোহাম্মদপুর রামচন্দ্রপুর খালের কথা। এক বছর আগে খালটি পুনরুদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। খনন কাজও শুরু হয়েছিল। পরে কাজটি আর এগোয়নি। ঢাকা জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং ডিএনসিসি সবার তালিকাতেই জায়গাটি খালের। সরেজমিন দেখা গেছে, খালের প্রায় পুরোটাই বেদখল হয়ে পড়েছে। যেন, দখলে কেহ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান। পরিবেশবিদদের মতে, রাষ্ট্রের নীরবতায় উচ্ছেদের পর আবার পুনঃদখল হচ্ছে। সরকারি সব সংস্থাই বলছে- তথ্য পেলে উচ্ছেদ করা হবে।

এই খাল দখলে কে নেই! আওয়ামী লীগ শাসনামলে আধাপাকা একটি ঘর নির্মাণ করে সেখানে ‘সুরের ধারা’ নামে গানের স্কুল করা হয়েছিল। এ নিয়ে দৈনিক আমাদের সময়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। আধাপাকা স্থাপনার জায়গায় হওয়ার কথা ছিল ১০তলা ভবন। খবরটি প্রকাশের পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সেই ভবন নির্মাণের ছাড়পত্র বাতিল করে। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সুরের ধারা স্কুল ভেঙে ফেলা হয়। সুরের ধারা চলে গেলেও দখলের ধারা থামেনি। আগের দখলদারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। টিনশেড বস্তি উচ্ছেদের পর নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন।

সরকারি কাগজে বেড়িবাঁধের দুই পাড়ে কম-বেশি ১২০ ফুট জায়গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের। আইন অনুযায়ী এই স্থানে কোনো স্থাপনা থাকার কথা না। কিন্তু বাস্তবে এক ফুট জায়গাও দখলের বাইরে নেই। মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধের দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য খামার, কাঠের দোকান, করাত কল ও বসতভিটা। কর্তৃপক্ষের নীরবতায় যে যার মতো করে দখল করেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের পর থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে কোনো অভিযান হয়নি। ফলে গত কয়েক বছর ধরে বহু স্থাপনা গড়ে উঠেছে। আদালত থেকে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ থাকলেও তা মানা হয়নি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে গতি পায়। গত সপ্তাহে গোড়ান চটবাড়ী এলাকা থেকে ধউর মোড় পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান চালায় পানি উন্নয়ন বোর্ড। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য এলাকাতেও উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারি এই সংস্থার। এ জন্য কয়েক দিন ধরে দখল হওয়া স্থাপনার সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড দিয়ে দখলদারদের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে পাউবো। সেই সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।

এ বিষয়ে ঢাকা পানি উন্নয়ন (সার্কেল-১) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) দেওয়ান আইনুল হক আমাদের সময়কে বলেন, বেড়িবাঁধের দুই পাড়ে কম-বেশি ১২০ ফুট করে জায়গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের। দীর্ঘ দিন ব্যবস্থা না নেওয়ায় অনেক জায়গাই দখল হয়ে গেছে। ২০১৯ সালের পর এবার উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। যেগুলো দখল হয়েছে, সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে।

এ ছাড়া রামচন্দ্রপুর মৌজার ‘রামচন্দ্রপুর খাল’ দখল করে আগে সাদেক অ্যাগ্রো নামে একটি গরুর খামার করা হয়েছিল। এরপর সেখানে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিক সাইনবোর্ড দেওয়া হয়। সেই সাইনবোর্ডের একটি কোনোরকমে টিকে আছে। তাতে ভূমির বর্ণনা করা হয়েছে- ‘এই জমিটি সরকারি খাস সম্পত্তি। রামচন্দ্রপুর মৌজার সিটি খতিয়ানের ১১৪১২ নম্বর দাগের ১.০৯৪৫ একর জায়গা।’ এক সময় খাল থাকলেও বর্তমানে সেটি ভূমির শ্রেণি হিসেবে নাল দেখানো হয়েছে। ফলে সাইনবোর্ডেই দখলের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। এই খাল পাড়ে রয়েছে ইউল্যাব ইউনিভার্সিটি। খালের সীমানা পাড়ে রয়েছে সূরের ধারা প্রতিষ্ঠানের টিনশেড পাকা বাড়ি। এই টিনশেড ঘরটিও খালের মধ্যে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

এ বিষয়ে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. বদরুদ্দোজা শুভ আমাদের সময়কে বলেন, মোহাম্মদপুর বাঁধের পাশে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনতার বাজার করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের জায়গা কারও দখলে থাকলে তথ্য পেলে অবশ্যই উচ্ছেদ করা হবে।

২০২৪ সালের জুন মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান করে সাদেক অ্যাগ্রো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। উচ্ছেদ করা হয় একাধিক টিনশেড ঘর। এরপর আর সেখানে নজর দেয়নি ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। ফলে নতুন করে গড়ে উঠেছে ব্যক্তিগত স্থাপনা। ইউল্যাব ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের কিছু অংশও দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে। গড়ে উঠেছে একটি ট্রাক স্ট্যান্ড।

পুনরায় দখলের বিষয়টি জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ আমাদের সময়কে বলেন, দখলের বিষয়টি আমরা অবগত হয়েছি। এরই মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে উচ্ছেদ করা হবে।

খালের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই খালটি প্রথমে ভরাট করে বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাক সমিতির অফিস করা হয়। এরপর ২০০৮ সালে ট্রাক সমিতি ভেঙে ৫৫ শতাংশ জমি উদ্ধার করা হয়। পরে ১১০ শতাংশ জমি সুরের ধারার নামে দখল করা হয়। সেই ১১০ শতাংশ জায়গাই এখন বেদখলে।

জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার আমাদের সময়কে বলেন, খাল, নদী জনগণের সম্পদ। জনগণের সম্পদ কেউ লিজ দিতে পারে না। যারা দিয়েছে তারা আইন ভঙ্গ করেছে। আমি দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে ২০১৯ সালে আমরা প্রতিবেদন দিয়ে সব খাল উচ্ছেদ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠিও দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো সংস্থাই ব্যবস্থা নেয়নি। এটা সংবিধানের লঙ্ঘন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি আদিলুর রহমান খান আমাদের সময়কে বলেন, দখল, উচ্ছেদ, পুনঃদখল- এই নাটক বহু বছর ধরেই চলছে। এত বড় বিপ্লবের পর আশা করেছিলাম দখলদারদের বিরুদ্ধে এই সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। আশ্চার্যজনক হলেও সত্য, এই সরকারও কথা বলছে না। বর্তমানে এই খাল উদ্ধার না হলে আগামীতে হবে বলে আশা করতে পারছি না। কর্তৃপক্ষের নীরবতা দখলদারদের উৎসাহিত করছে। এসবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।