র‌্যাবের গুমঘরে কৃষক মুসলিমের ২৬ দিন

৭টি মিথ্যা মামলার আসামি

শাহজাহান আকন্দ শুভ
৩০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
র‌্যাবের গুমঘরে কৃষক মুসলিমের ২৬ দিন

আমি কোনো অপরাধী নই। কিন্তু আমাকে অপরাধী বানানো হয়। ২০২১ সালের ৪ আগস্ট আমাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে অপহরণ করে র‌্যাব। এরপর ২৬ দিন ঢাকার উত্তরায় র‌্যাব-১ অফিসের গুমঘরে রাখে। সেখানে আমার ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়। গুম থাকা অবস্থায় আমাকে মুক্তি দেওয়ার কথা বলে পরিবারের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু আমাকে মুক্তির বদলে র‌্যাবের গুমঘরে রেখে প্রতিদিনই নির্যাতন করা হতো। পরে জানতে পারি র‌্যাবের সোর্সের সঙ্গে তর্কাতর্কির জের ধরেই আমার ওপর জুলুম নির্যাতন নেমে আসে। ২৬ দিন পর অস্ত্র ও মাদক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আমাকে কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর আমি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পাই। তারা জানতে পারেন আমি বেঁচে আছি। গতকাল শুক্রবার আমাদের সময়কে এ কথা

বলেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের মো. নুরুল ইসলামের ছেলে মো. মুসলিম উদ্দিন। পেশায় কৃষক মুসলিম উদ্দিনকে ২০২১ সালের ৪ আগস্ট গোবরাতলা ইউনিয়ন পরিষদের পাশের একটি বাড়ি থেকে র‌্যাব ৫-এর সদস্যরা তাদের গাড়িতে তোলে। এরপর চোখ বেঁধে নিয়ে যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। সেখান থেকে র‌্যাবের ক্যাম্প হয়ে তাকে উত্তরা র‌্যাব কার্যালয়ের গুমঘরে রাখা হয়। সেখানেই ২৬ দিন বন্দি ছিলেন কৃষক মুসলিম। এরপর ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট তাকে অস্ত্র ও মাদক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় হস্তান্তর করা হয়। ১৪ মাস কারাগারে থেকে অবশেষে তিনি জামিনে মুক্ত হন। তাকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো, নির্যাতন এবং ২৬ দিন গুম করে রাখার ঘটনায় মুসলিম উদ্দিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। এতে তাকে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও গুমের সঙ্গে জড়িতদের বিচার চাওয়া হয়েছে।

মুসলিম উদ্দিন বলেন, আমি কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করি। কোনোদিন কোনো অন্যায় কাজে জড়িত ছিলাম না। কিন্তু র‌্যাবের সোর্স আলী নবীর সঙ্গে তর্কাতর্কির জেরে আমাকে একে একে পাঁচটি মিথ্যা মামলায় জড়ায় র‌্যাব। আমার বিরুদ্ধে দেওয়া হয় অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকের মিথ্যা মামলা। এই মামলার ঘানি টানতে টানতে যখন আর পেরে উঠছিলাম না, তখন আমাকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে। আর আমাকে ধরতে র‌্যাবের বিশাল বহর নামানো হয়। এমনকি আমি গুম থাকা অবস্থায় আমার পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। কিন্তু গরু বিক্রি এবং মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে ৮ লাখ টাকা জোগাড় করে পরিবার। পরে সেই টাকা র‌্যাবের সোর্স আলী নবীর হাতে তুলে দেয় পরিবার। কিন্তু মুক্তির বদলে আমার ওপর আরও নির্যাতন নেমে আসে।

মুসলিম উদ্দিন আরও বলেন, র‌্যাব-১ নেওয়ার পর এক লোক খাতাকলম হাতে আমার নাম-ঠিকানা লেখেন। তারপর জানতে চায় ‘আমার নামে এত মামলা কেন?’ এই বলেই আমার কানের ওপর জোরে একটি চড় দেয়। তারা আমার হাতে দুটি হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে হাত পেছন দিয়ে উল্টা করে ঝুলিয়ে পায়ে লাঠিপেটা শুরু করে। তাদের রুমগুলো এমন ছিল যে সাউন্ড বাইরে যায় না। আমার সাথে একইসঙ্গে তিন-চারজনকে একইভাবে নির্যাতন করা হয়। সেখানে ডিউটিরত দুজন আমাকে খাবার খেতে দেয়, নামাজের সময় হ্যান্ডকাফ খুলে দেয়। মাঝে মাঝে রাতের বেলা হঠাৎ এসে কিছুক্ষণ পিটিয়ে আবার চলে যায়। সারাদিন এভাবেই হ্যান্ডকাফ লাগানো অবস্থায় পড়ে থাকি। একদিন একজন এসে আমাকে বলেন ২০১৩-১৪ সালে তুই র‌্যাবের সোর্স আলী নবীকে চড় মেরেছিলি। এই বলেই নির্যাতন করতে থাকে। এভাবে র‌্যাব ১-এ থাকা অবস্থায় আমাকে প্রতিদিনই নির্যাতন করা হতো।

মুসলিম উদ্দিন বলেন, ২৬ দিন পর র‌্যাব-১ থেকে চোখ বেঁধে দুই হাতে হ্যান্ডকাফ ও পায়ে ডা-াবেড়ি পরিয়ে একটি হায়েস গাড়িতে করে যাত্রাবাড়ীতে র‌্যাব ১০-এর কার্যালয়ে নিয়ে আসে। সেখানে সিসি ক্যামেরা লাগানো তিন হাতের ছোট্ট একটি রুমে রাখা হয়। ওই দিনটি ছিল ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট। ওই দিনই আমাকে চোখ বেঁধে, হাতে হ্যান্ডকাপ এবং পায়ে লোহার বেড়ি পরিয়ে আবার গাড়িতে তোলা হয়। তখন আমার মনে হয়েছিল এ দিনই হয়তো আমার শেষ দিন। আমি তখন আমার সাড়ে ৩ বছরের ছেলের জন্য শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া চাইছিলাম। আমি মরে গেলে আমার পরিবারের কী হবে এই চিন্তায় আরও মুষড়ে পড়ি।

কৃষক মুসলিম বলেন, এরপর এক পরিত্যক্ত জায়গায় এসে থামে র‌্যাবের গাড়ি। পরে ১৩-১৪ বছরের একটি ছেলেকে নিয়ে এসে আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘একে চিনিস?’ চিনি না বলার পর, ওরা সেই অজ্ঞাত লোকদের দিয়ে কাগজে স্বাক্ষর করায়। পরে তাদের সাক্ষী বানানো হয়। ওই দিন সকাল ১১টায় আমাকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় নিয়ে আসে র‌্যাব। থানায় এসআই মনির নামের একজনের মোবাইলে আমি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পাই। তখন পরিবার জানতে পারে, আমি বেঁচে আছি। তখন পুলিশ আমার নামে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মাদক ও একটি অস্ত্র মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখায়। এরপর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করে। দুটি মামলায় আমি খালাস পেয়েছি। এখনও পাঁচটি মামলা চলছে। আমি হাজিরা দিয়ে যাচ্ছি। জানি না এই সব মিথ্যা মামলা আর হয়রানি থেকে কবে মুক্তি পাব।