অনিয়ম-উপেক্ষায় বান্দরবানে দারিদ্র্য ৬৫ শতাংশ
সবুজ পাহাড় আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা বান্দরবান আজও দারিদ্র্যের ঘেরাটোপে আটকে আছে। দেশের গড় দারিদ্র্যের হার যেখানে ২৪ শতাংশ, সেখানে ১৩ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত জেলায় তা তিন গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশে। ভৌগোলিক বৈষম্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা, ভূমি মালিকানার জটিলতা, স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি এবং উন্নয়ন প্রকল্পের অনিয়ম- এসব কারণেই দরিদ্রতার দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছে না বান্দরবানের মানুষ। পরিকল্পনা কমিশনের প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইনডেক্স ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেখানে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৪.০৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, সেখানে বান্দরবানে এই হার ভয়াবহ রকমের বেশি ।
বান্দরবানের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা অরণ্যে আচ্ছাদিত। এখানে দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থা এখনও বড় সমস্যা। অনেক গ্রামে যাতায়াতের একমাত্র উপায় পায়ে হাঁটা বা ঝুঁকিপূর্ণ ঝুলন্ত সেতু পার হওয়া। সড়ক নির্মাণ হলেও বর্ষায় তা ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ফলে বাজারে কৃষিপণ্য পৌঁছানো কঠিন, কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের একমাত্র পেশা কৃষি।
??স্থানীয় বাসিন্দা ম্রো জনগোষ্ঠীর কৃষক লামাই ম্রো আমাদের সময়কে বলেন, আমরা পাহাড়ে সবজি চাষ করি, কিন্তু তা বাজারে নিয়ে যেতে দুই দিন লাগে। সমতল থেকে আনা সবজি কয়েক ঘণ্টায় বাজারে পৌঁছে যায়। আমরা তাই কম দামে বিক্রি করি, অনেক সময় সবজি নষ্ট হয়ে ক্ষতির মুখে পড়ি।
ভৌগোলিক দুর্গমতায় বান্দরবানের অর্থনীতি মূলত কৃষি ও বননির্ভরতা থেকে বেরোতে পারেনি। শিল্প, পর্যটন বা বিকল্প অর্থনৈতিক খাত প্রসারিত হয়নি। অনেকটা উপেক্ষা করা হয়েছে শিল্প নির্মাণে।
শিক্ষা দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম হাতিয়ার হলেও পাহাড়ি এলাকাগুলোয় এখনও শিক্ষার মান নিম্নস্তরে। দুর্গম এলাকায় বিদ্যালয়ের সংখ্যা সীমিত। শিশুরা অনেক সময় বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারে না। এ ছাড়া মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর উদ্যোগ থাকলেও তা এখনও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
ফলে ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। বিশেষ করে ম্রো, চাক, খুমি ও খেয়াং জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাক্ষরতার হার দেশের সর্বনিম্ন স্তরে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ আরও সীমিত। ফলে তারা কর্মসংস্থানের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে।
খিয়াং তরুণ জনি আমাদের সময়কে বলেন, আমরা পড়াশোনা করতে চাই; কিন্তু কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় শহরে। যাওয়ার খরচ জোগাড় করতে না পেরে অনেকেই মাঝপথে পড়ালেখা ছেড়ে দেয়। বান্দরবানের একটি মাত্র প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়েছে, সেখানে পড়া অনেক ব্যয়বহুল।
বান্দরবানের অধিকাংশ মানুষ কৃষক, জুম চাষ, ফলদ বাগান, বনজ সম্পদ আহরণ ও ছোট ছোট ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু জুম চাষ টেকসই নয়; এতে উৎপাদন কম হয়। অন্যদিকে বাজারব্যবস্থা দুর্বল থাকায় কৃষিজাত পণ্যের সঠিক দাম পাওয়া যায় না।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক থানজামা লুসাই ?বলেন, এখানে বড় ধরনের শিল্প বা কারখানা নেই বললেই চলে। ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানও সীমিত। অর্থ সংকটের কারণে তরুণরা শহরে বা দেশের বাইরে যেতে পারছেন না। বান্দরবানে ১৩ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছে না।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
স্বাস্থ্যসেবার অভাবে দারিদ্র্য আরও গভীর হয়। দুর্গম উপজেলাগুলোয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও লোকবল নাই, যারা নিয়োজিত আছেন, তারাও পাহাড়ের বসবাসরত সহজ-সরল পেয়ে অনুপস্থিতি থাকেন। জেলা সদর হাসপাতাল থাকলেও দূরবর্তী গ্রাম থেকে সেখানে পৌঁছাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগে। এ কারণে সাধারণ অসুখও অনেক সময় ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
গর্ভবতী মা, শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ভোগে। চিকিৎসার জন্য শহরে যেতে গেলে পরিবহন খরচ যোগ হয়, যা দরিদ্র পরিবার বহন করতে পারে না। ফলে অনেক পরিবার চিকিৎসা না করিয়েই দুঃখ-কষ্টে দিন কাটায়।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অন্যতম বড় সমস্যা হলো ভূমি মালিকানা। অনেকের হাতে জমির দলিল না থাকায় সরকারি সহায়তা বা ব্যাংক ঋণ পায় না। জুম চাষ নির্ভর অর্থনীতি নিরাপত্তাহীন। বছরের পর বছর জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল থাকলেও তা দিয়ে পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।
আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কেএস মং বলেন, ভূমি মালিকানার সমস্যার সমাধান না হলে দারিদ্র্য কমানো সম্ভব নয়। জমির মালিকানা না থাকলে মানুষ বিনিয়োগ করতে পারে না, উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্র চাইলে বান্দরবানবাসীর ভাগ্যের সবকিছু বদলে দিতে পারে কিন্তু তা করছে না। ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধান এবং উন্নয়ন প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে দুর্গম গ্রাম পর্যন্ত। নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে যুক্ত করা ও বাজারব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
বান্দরবানের উন্নয়নের জন্য সরকার ও উন্নয়ন সংস্থা নানা প্রকল্প নেয়। কিন্তু বাস্তবে এসব প্রকল্পের সুবিধা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় না। অনিয়ম, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রকৃত উপকারভোগীরা সবসময় বঞ্চিত হয়। অনেক সময় উন্নয়ন বরাদ্দ খাতভিত্তিক হলেও তা প্রকৃত সমস্যার সমাধান করে না। যেমন রাস্তা হয়েছে; কিন্তু বাজারজাতকরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। স্কুল হয়েছে, কিন্তু শিক্ষক নেই। ফলে সমস্যার মূলে না গিয়ে উপরিতলে সমাধান টানতে গিয়ে দারিদ্র্য কমছে না।
বান্দরবানের মানুষের দারিদ্র্য কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি জাতীয় উন্নয়নের জন্যও চ্যালেঞ্জ। ১৩ জনগোষ্ঠীর এই বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হলে তাদের দারিদ্র্যমুক্ত করাই হবে টেকসই উন্নয়নের প্রথম ধাপ। নইলে পাহাড়ের মানুষ ৬৫.৩৬ শতাংশ দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে থাকবে।
বান্দরবানকে সমৃদ্ধ করতে কোটি কোটি টাকার কৃষি প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে প্রকল্পের অনিয়ম ও অর্থ লোপাটের কারণে পাহাড়ি কৃষকের ঘরে কোনো উন্নয়ন পৌঁছায়নি। এই অব্যবস্থাপনা বান্দরবান জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য ও পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ- বলছেন বান্দরবানে অধিকারকর্মী স্থানীয় সংবাদকর্মী মংহাই থুই মারমা।