প্রশাসনে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দুর্নীতিবাজরাও ‘বঞ্চিত’

মন্ত্রণালয়ে অভিজ্ঞতার অভাব শিখতে হচ্ছে সচিবদেরও ।। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বাড়তি চাপেও নেই উন্নতি ।। অবসরে গিয়েও পদোন্নতি, মিলছে বাড়তি ভাতা ও পেনশন ।। সচিব হওয়ার লোভে ব্যক্তিগত স্ট্যাটাসের আশায় আবেদন

তাওহীদুল ইসলাম
২৮ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
প্রশাসনে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দুর্নীতিবাজরাও ‘বঞ্চিত’

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনে ‘বঞ্চিত’ দাবিদারদের পোয়াবারো। অবসরে যাওয়া শত শত কর্মকর্তা এক লাফে তিন-চার ধাপ এগিয়ে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়েছেন। এতে তারা সচিব পরিচয়সহ বাড়তি বেতন-ভাতা ভোগ করছেন। এ ছাড়া পদোন্নতিতে অনেক শাস্তিপ্রাপ্ত ও দুর্নীতিবাজও সুবিধাভোগী হয়েছেন। প্রথমে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা, এরপর অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এ সুবিধা পেয়েছেন। বাকিরাও এ ধরনের সুবিধার আবদার করছেন। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে, দেশের প্রশাসন আসলে কতটা লাভবান হলো?

অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের একটা অংশ নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে সামাজিক স্ট্যাটাস পাওয়ার আশায় ধরনা দিয়েছেন। এক লাফে চারটি পদোন্নতি বা তিনটি পদোন্নতি পেয়ে সচিব মর্যাদা পরিচয় দিতে পারার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন নানা কায়দায়। অবশ্য ‘বঞ্চিত’ নির্ধারণ নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। যদিও কমিটি গঠন করে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য বাদ পড়াদের মধ্যে এ নিয়ে রয়েছে ক্ষোভ। ভবিষ্যতে এ ধরনের সুবিধা দিতে রাষ্ট্রের বাড়তি অর্থ বরাদ্দে চাপ আসতে পারে। সুবিধাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও আর্থিক উন্নতি ছাড়া দেশের কী কল্যাণ হয়েছে- এ নিয়ে নানা মত রয়েছে। এসব বাড়তি সুবিধা দিলেও প্রশাসনে তেমন উন্নতি হয়নি। এ নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন প্রশাসনের তরুণ কর্মচারীরা।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত কেউ কেউ একসঙ্গে চারটি পদোন্নতি পেয়ে সচিব হয়েছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তা দুটি, কেউ কেউ তিনটি পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোর সঙ্গে তাদের কাজের তেমন অভিজ্ঞতা নেই। ফলে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে প্রকল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে কীভাবে তদারকি করতে হয়, সে বিষয়ে গত ১৯ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মশালার আয়োজন করতে বাধ্য হয় সরকার। সেখানে তাদের সার্বিক ধারণা দেওয়া হয়েছে। শেখানোর চেষ্টা চলছে নানা বিষয়াদি। দেখা গেছে, পলাতক হাসিনা সরকারের আমলে যারা গুরুত্বহীন দায়িত্বে কিংবা ওএসডি ছিলেন, তাদের দিয়ে প্রশাসনে গতি ফেরানো কঠিন হয়ে গেছে। বহুদিন কাজের বাইরে থাকায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে তারা ক্ষেত্রবিশেষে অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের এ বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার কর্মশালার পাশাপাশি নানা পন্থা বের করছে। উদ্দেশ্য- দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার দেখা করলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এ নিয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিঞা বলেন, প্রশাসনের বর্তমান অবস্থা নাজুক। এমন দুরবস্থা অতীতে ছিল না। ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি নিয়ে বিতর্ক আছে। কোন ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। এতে করে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। আছে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ। অভিযোগের পর কোনো তদন্ত করা হয়নি। জানা গেছে, আমলাতন্ত্রকে দক্ষ ও নিরপেক্ষ করার জন্য সংস্কার শুরুর বদলে নিয়মিত কর্মচারীসহ অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের একের পর এক পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকেই বিতর্কিত ও অযোগ্য। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ১৬ বছরে জনপ্রশাসন থেকে অবসরে যাওয়া সাবেক ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ‘ভূতাপেক্ষ’ পদোন্নতি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এসব কর্মকর্তা এরই মধ্যে অবসরে গেছেন। আগের কোনো তারিখ থেকে কোনো বিষয় কার্যকর করা হলে তাকে ‘ভূতাপেক্ষ’ বলা হয়। গত ৯ ফেব্রুয়ারির প্রজ্ঞাপনে উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত এই পদোন্নতি দেওয়া হয়।

বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বিষয়ে গঠিত জাকির আহম্মেদ খান কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এর মধ্যে ১১৯ জনকে সচিব পদে, ৪১ জনকে গ্রেড-১, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন এবং উপ সচিব পদে চারজনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ওই ৭৬৪ কর্মকর্তার মধ্যে ৯ জনকে চার ধাপ, ৩৪ জনকে তিন ধাপ, ১২৬ জনকে দুই ধাপ ও ৫৯৫ জনকে এক ধাপ পদোন্নতি দেওয়া হয়। ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির বাস্তবায়নে বকেয়া পেতন আনুতোষিক ও পেনশন বাবদ এককালীন আনুমানিক ৪২ কোটি টাকা এবং পরবর্তী সময়ে পেনশন বাবদ বছরে অতিরিক্ত ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করার কথা বলা হয়েছে। কমিটির কাছে মোট ১ হাজার ৫৪০টি আবেদন জমা পড়েছিল। এর মধ্যে মারা যাওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে তাদের পরিবারের সদস্যদের করা ১৯টি আবেদন ছিল। যাচাই-বাছাই করে কমিটি ৭৬৪ জনের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করে।

তাদের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া ৫১ জনের মধ্যে ৫০ জনই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের নিজের ব্যাচ ১৯৮২-এর কর্মকর্তা বলে অভিযোগ তুলেছেন আলোচিত কর্মকর্তা মাহবুব কবির মিলন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানের উদ্দেশে ফেসবুক স্ট্যাটাসে তাৎক্ষণিক তিনি প্রশ্ন রাখেন- ১১৯ জন সচিবের মধ্যে ৫১ জন অতিরিক্ত সচিব যারা পদোন্নতি পেলেন, তারা কীভাবে কোন ক্রাইটেরিয়ায় বঞ্চিত ছিলেন? কীভাবে নিপীড়িত নির্যাতিত ছিলেন?’ একই ব্যাচের বিশেষ করে ৮২ ব্যাচের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে বর্তমানে চুক্তিভিত্তিক প্রশাসন চালানো নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সাবেক এ অতিরিক্ত সচিব।

প্রশাসন ক্যাডারের পর গত ২০ আগস্ট অন্যান্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করেছে এ সংক্রান্ত পর্যালোচনা কমিটি, যাদের পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে গ্রেড-১ পদে ১২ জন, গ্রেড-২ পদে ৩২ জন এবং গ্রেড-৩ পদে ৩৪ জন কর্মকর্তা আছেন। পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক ও সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানের কমিটির দ্বিতীয় প্রতিবেদন এটি। প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য যেসব ক্যাডারে তৃতীয় গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদ রয়েছে, সেসব ক্যাডারের বঞ্চিত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৩১৮টি আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে ৬৮টি আবেদন কমিটির আওতাবহির্ভূত ছিল। আর ৪০টি আবেদন তথ্যগতভাবে অসম্পূর্ণ ছিল। পরে কমিটি ২১০টি আবেদন পর্যালোচনা করে। পর্যালোচনায় কমিটি ৭৮ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে ছয় কর্মকর্তাকে তিন ধাপ, ১৭ জন কর্মকর্তাকে দুই ধাপ এবং ৫৫ জন কর্মকর্তাকে এক ধাপ পদোন্নতির সুপারিশ করেছে। ১৩২ জন কর্মকর্তাকে কমিটি পদোন্নতির সুপারিশ করেনি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও জনপ্রশাসনে বিরাজ করছে অস্থিরতা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হাতাহাতির ঘটনায় জড়িত প্রশাসন ক্যাডারের ১৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তে সত্যতা মিললেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের কয়েকজনকে বরং উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে উন্নীত করা হয়েছে। গত সরকারের আমলে প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তাদের পদোন্নতি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু বিভাগীয় মামলায় শাস্তিপ্রাপ্ত ও দুর্নীতিবাজ অনেকেও পদোন্নতি পেয়েছেন। দেখা যাচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরও আগের মতো চলছে প্রশাসন। পদোন্নতি ও বদলিতে এখনও মূল বিবেচ্য বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব। তবে গত এক বছরে ৯ জন সচিব ও ১৯ জন অতিরিক্ত সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে এবং আরও ৮৭ জনকে ওএসডি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া বিতর্কিত দুই নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকারী ৫১ ডিসিকে ওএসডি এবং দুর্নীতি ও সরকারি কর্মচারী আইন লঙ্ঘনের দায়ে একজন যুগ্ম সচিব ও একজন সহকারী কমিশনারকে বরখাস্ত করাসহ কিছু সাহসী পদক্ষেপ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের।

এ নিয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিঞা বলেন, প্রশাসনের বর্তমান অবস্থা নাজুক। এমন দুরবস্থা অতীতে ছিল না। ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি নিয়ে বিতর্ক আছে। কোন ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। এতে করে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। আছে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ। অভিযোগের পর কোনো তদন্ত করা হয়নি।