গ্রীন-গোল্ড /
বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানি-বৈশ্বিক সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও নীতিগত করণীয়
বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ। দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত এবং জাতীয় মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) প্রায় ১২-১৩ শতাংশ আসে কৃষি খাত থেকে (BBS, ২০২৪)। স্বাধীনতার পর নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। তবে শুধু খাদ্য নিরাপত্তায় সীমাবদ্ধ থেকে নয়, বরং কৃষিপণ্যকে রপ্তানিমুখী খাতে রূপান্তরিত করে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন অবস্থান তৈরি করার সুবর্ণ সুযোগ এখন বাংলাদেশের সামনে রয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (EPB, ২০২৪) তথ্যমতে, কৃষি ও কৃষিভিত্তিক প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে বর্তমানে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। এর মধ্যে ফ্রোজেন ফিশ ও সীফুড থেকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন, শাকসবজি ও ফলমূল থেকে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন এবং চাল, আচার, মশলা ও অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য থেকে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আসে। যদিও এ সংখ্যা বাড়ছে, তা এখনো বৈশ্বিক মানদণ্ডে অত্যন্ত সীমিত।
তুলনা করলে দেখা যায়, ভিয়েতনাম শুধু চাল রপ্তানি করেই বছরে ৪.২ বিলিয়ন ডলার আয় করছে (FAO, ২০২৩)। থাইল্যান্ড কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য থেকে ৪৫ বিলিয়ন, ভারত প্রায় ৫০ বিলিয়ন এবং নেদারল্যান্ডস ১২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করছে (WTO, ২০২৩)। ফলে স্পষ্ট যে, উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অবকাঠামোগত দুর্বলতা, নীতিগত ঘাটতি ও বাজার সম্প্রসারণে ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে আছে।
বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য:
বাংলাদেশি কৃষিপণ্যের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা এক বিশাল প্রাকৃতিক বাজার তৈরি করেছেন। World Bank Migration Data, ২০২৩ অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন এবং ২০২৭ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ২ কোটিতে পৌঁছাবে। এই বিশাল প্রবাসী কমিউনিটি বাংলাদেশি কৃষিপণ্যের অন্যতম প্রধান ক্রেতা।
মধ্যপ্রাচ্যে চাল, মাছ ও সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
ইউরোপে বাংলাদেশি ফ্রোজেন ফুড, মশলা ও আচার জনপ্রিয় হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটি বাংলাদেশি পণ্যের প্রতি বেশি ঝুঁকছে।
আরও পড়ুন:
সব প্রতীক্ষার সমাধান হবে?
লন্ডনের সুপারশপগুলোতে বাংলাদেশি সবজি ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
এখন বিশ্বের বিভিন্ন সুপারশপে বাংলাদেশি শতাধিক ফ্রোজেন ও ফ্রেশ পণ্য পাওয়া যায়। এটি প্রমাণ করে-যদি সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া যায়, তবে কৃষিপণ্য রপ্তানি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত হয়ে উঠতে পারে।
মূল সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ :
বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানির পথে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে-
১. সংরক্ষণ ও অবকাঠামোর ঘাটতি: দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মাত্র ৫-৭ শতাংশ আধুনিক কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হয় (FAO Bangladesh Report, ২০২৩)। ফলে প্রতিবছর ২৫-৩০ শতাংশ শাকসবজি, ফলমূল ও মাছ নষ্ট হয়ে যায়, যা অর্থমূল্যে কয়েক বিলিয়ন ডলার সমান।
২. আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অভাব : HACCP, GAP এবং ISO সার্টিফিকেশন না থাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার থেকে একাধিকবার বাংলাদেশি কৃষিপণ্য ফেরত এসেছে।
৩. পরিবহন ব্যয়ের উচ্চতা : ঢাকায় এয়ার কার্গো ভাড়া দিল্লির তুলনায় প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ বেশি (IATA, ২০২৪)। এতে আমাদের রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
৪. বাজার গবেষণার অভাব : কোন দেশে কোন কৃষিপণ্যের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, সে বিষয়ে কোনো জাতীয় ডাটাবেজ নেই।
৫. ব্র্যান্ডিং ও বিপণনে দুর্বলতা : বাংলাদেশি কৃষিপণ্যের শক্তিশালী আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এখনো তৈরি হয়নি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পণ্য অন্য দেশের নামে বিক্রি হচ্ছে।
করণীয় ও নীতিগত প্রস্তাবনা :
বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানি সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো জরুরি-
১. আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ ও এগ্রো-হাব নির্মাণ : প্রতিটি বিভাগীয় শহরে আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ, ফুড প্রসেসিং জোন ও এগ্রো-হাব স্থাপন করতে হবে।
২. সার্টিফিকেশন সহায়তা : কৃষকদের HACCP, GAP ও ISO সার্টিফিকেশন পেতে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের মতো রাষ্ট্রীয় সহায়তা এ খাতে অপরিহার্য।
৩. কার্গো ভর্তুকি ও এগ্রো-টার্মিনাল : এয়ার কার্গো ভাড়ায় ভর্তুকি চালু করা এবং সমুদ্রবন্দরে ডেডিকেটেড এগ্রো-কার্গো টার্মিনাল স্থাপন করা জরুরি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
৪. জাতীয় এগ্রো-এক্সপোর্ট রিসার্চ সেন্টার : বৈশ্বিক বাজার গবেষণা, সম্ভাব্য নতুন পণ্য এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রবণতা বিশ্লেষণের জন্য একটি কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
৫. বিদেশে ট্রেড হাউস ও সুপারশপ নেটওয়ার্ক : প্রবাসী বাংলাদেশি এবং স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে সরাসরি পণ্য পৌঁছানোর জন্য বিদেশে বাংলাদেশি ট্রেড হাউস ও সুপারশপ গড়ে তুলতে হবে।
৬. জাতীয় অগ্রাধিকার ঘোষণা : কৃষিপণ্য রপ্তানিকে জাতীয় অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। যেমনভাবে তৈরি পোশাক শিল্পকে (RMG) বিশেষ নীতি সহায়তা দিয়ে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি খাতে উন্নীত করা হয়েছে।
সম্ভাব্য সুফল :
যদি এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা যায়, তবে আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ অন্তত ৫-৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে সক্ষম হবে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে, গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
এক সময় বাংলাদেশকে “পাট ও চায়ের দেশ” বলা হতো। নতুন শতকে কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি হতে পারে বাংলাদেশের ‘গ্রীন-গোল্ড’। সঠিক নীতি সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক ব্র্যান্ডিং কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে কৃষিপণ্য রপ্তানিকে দেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম প্রধান খাতে পরিণত করা সম্ভব। এটি শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই আনবে না, বরং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জন এবং উন্নত রাষ্ট্রে উত্তরণের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবেও কাজ করবে।