সড়কে বেপরোয়া যান ঝরাচ্ছে রক্ত

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
২৬ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সড়কে বেপরোয়া যান ঝরাচ্ছে রক্ত

সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। দেশে মোট দুর্ঘটনার প্রায় অর্ধেকই ঘটছে চালকের অতিরিক্ত গতিতে নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৫ কিলোমিটার দ্রুতগতিতেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায় চারগুণ। তবে যাত্রীচাপ, প্রতিযোগিতার মানসিকতা ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে বিদ্যমান যানবাহন আইন কার্যকর হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- প্রযুক্তি, আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা এক সঙ্গে না থাকলে গতিসীমা কাগজে-কলমেই থাকবে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, গত জুলাই মাসে ৪৪৩টি দুর্ঘটনায় ৪১৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৮৫৬ জন। ১৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ১০৯ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ২৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গত মাসে ২১৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, যা মোট দুর্ঘটনার ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সড়কে স্পিড ক্যামেরা ও জিপিএস বসাতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে হবে।

দুর্ঘটনা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অধিকাংশ দুর্ঘটনা কারণ অতিরিক্ত গতি। এ ছাড়া পথচারীদের অসচেতনতার কারণেও সড়কে নিহতের ঘটনা বাড়ছে। এই গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি এবং চালকদের প্রশিক্ষণ দরকার। এ জন্য সরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে জীবনঘনিষ্ঠ সচেতনতামূলক প্রচার চালাতে হবে।

সড়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস, জিপ ও প্রাইভেট কারের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। চালকরা অনেক সময় ১০০ কিলোমিটার বা তার বেশি গতিতে গাড়ি চালান। ভারী গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে মোটরসাইকেল, যার সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। এতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। যাত্রীরাও গতি কমালে চালককে ব্যঙ্গ করেন।

বেসরকারি ব্যাংকের চাকরিজীবী লিয়াকত হোসেন বলেন, তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর। তিনি বেশিরভাগ সময় বৃহস্পতিবার অফিস শেষে গ্রামের বাড়ি যান। গুলিস্তান থেকে বাস ছেড়ে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলে গাড়ির গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি বা আরও বেশি থাকে। চালকদের তিনি নির্ধারিত গতিসীমায় গাড়ি চালাতে বলেন। কিন্তু গতিসীমা কমালে যাত্রীরাই তাকে ব্যঙ্গ করে ‘ঠেলাগাড়ির ড্রাইভার’ বলে। আবার বাসের পাশ দিয়ে মোটরসাইকেল ওভারটেক করে চলে যায়। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানের অভিযোগে রাস্তায় পুলিশ বা প্রশাসনের কাউকে কোনো দিন গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসা কিংবা জরিমানা করতে দেখেননি বলে জানান এই যাত্রী।

প্রায় দুই যুগ ধরে ভাড়ায় ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাইক্রোবাস চালান ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ অন্য ধীরগতির যান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেও সরকার তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এসব গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ হারায়। দীর্ঘ সময় না ঘুমিয়ে গাড়ি চালানোর ফলে অনেক চালক দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে নিয়ন্ত্রণ হারান।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, শুধু আইন থাকলেই হবে না; প্রযুক্তি, অবকাঠামো ও জনসচেতনতা এক সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে। লাইসেন্স-ব্যবস্থাও কঠোর করতে হবে। আর সবকিছুর ওপরে আইন অমান্যের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকা এবং তা কার্যকর করা জরুরি।

চট্টগ্রামের হালিশহরে গত ১২ জুন একটি সড়ক দুর্ঘটনা সারাদেশে আলোচিত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে দামি গাড়ি চালাচ্ছিলেন তানিম হোসেন নামে এক যুবক। তার বেপরোয়া গতি বাইসাইকেলচালক ওসমান গনিকে পিষে ফেলে। জানা যায়, তানিমের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না।

হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার মহাসড়কে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরাসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১ হাজার ৪২৭টি ক্যামেরা বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে আগে থেকেই ক্যামেরা আছে। এসব ক্যামেরা সংক্রিয়ভাবে অতিরিক্ত গতি শনাক্ত করে মামলা করতে পারবে।

এ প্রসঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজি মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে চালু হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় শনাক্তকরণ (অটোফাইন্ডার) ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে মহাসড়কে চলাচল করা যে কোনো গাড়ির তাৎক্ষণিক গতি (৩০ সেকেন্ডের মধ্যে), রেজিস্ট্রেশন নম্বর, লেন ও অবস্থান জানা যাবে। কাজ প্রায় শেষ, দ্রুতই অপারেশনে যাবে হাইওয়ে পুলিশ। চুরি-ডাকাতি প্রতিরোধের পাশাপাশি হুটহাট লেন পরিবর্তন, অতিরিক্ত গতিতে চলাচল, উল্টো পথ ব্যবহার, যানবাহনের অবস্থান শনাক্ত করাসহ মহাসড়কের সার্বিক পরিস্থিতি থাকবে নজরদারিতে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশের সব অঞ্চলের মহাসড়কগুলো আনা হবে সিসি ক্যামেরার আওতায়।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) ভাইস চেয়ারম্যান লিটন এরশাদ বলেন, দেশে আধুনিক গতিমাপের যন্ত্র কম। টহলও নিয়মিত হয় না। ফলে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালালেও ধরা পড়ার ঝুঁকি কম। আবার প্রভাবশালীদের গাড়ির ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ হয় না। এতে সাধারণ চালকরাও নিয়ম মানেন না।