প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ প্রত্যাবাসন
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর পূর্ণ হতে চলেছে আজ। নিজ দেশ মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে এ দিন সীমান্ত পেরিয়ে উখিয়া-টেকনাফে অনুপ্রবেশ করেছিল প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। আগে থেকে অবস্থানকারীদের মিলিয়ে বর্তমানে এ সংখ্যা ১৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিনই সীমান্তের কোনো না কোনো পয়েন্ট দিয়ে নতুন করে আসছে তারা। গত অর্ধযুগ ধরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রচেষ্টা চললেও কাউকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে নানা আশ্বাসেও প্রত্যাবাসনের স্বপ্ন প্রতিবারই থমকে গেছে রাখাইনের সহিংসতা, ত্রাণ সংকট এবং রাজনৈতিক জটিলতায়। এমন বাস্তবতায় রোহিঙ্গা ঢলের অষ্টম বর্ষপূর্তিতে কক্সবাজারের ইনানীতে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্মেলন। আজ এই সম্মেলনে যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গেল রমজানে জাতিসংঘ মহাসচিবকে পাশে বসিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী রমজানে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ঈদ করবে। সেই আশাতে নতুন করে বুক বাঁধছে তারা। অন্যদিকে দুশ্চিন্তা ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে সীমান্তের স্থানীয় মানুষ। শুধু ক্যাম্প নয়, পুরো কক্সবাজার জুড়ে আলোচনা চলছে প্রধান উপদেষ্টার পদক্ষেপে সমাধানের উপায় বের হয় কিনা? এর মধ্যেই রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সহিংসতায় আবার বাংলাদেশমুখী হচ্ছে রোহিঙ্গারা। সম্প্রতি উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। সরকারি হিসাবে তাদের নাম নেই।
টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্প সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহে কমপক্ষে ২০০ জনের অধিক রোহিঙ্গা উখিয়া টেকনাফে অনুপ্রবেশ করেছে। স্থলপথে বিজিবির কড়াকড়ির কারণে তারা ভেলা-ছোট নৌকায় নাফ নদ পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশ করে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তে বিপুলসংখ্যক জড়ো হয়েছে।
উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এবার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া উচিত। তাদের কারণে স্থানীয়রা হয়রানি ও ঝুঁকির মধ্যে আছে। এলাকায় অপহরণ, চাঁদাবাজি, খুন, গুম ও মাদক কারবার বেড়েছে। বনভূমি, কৃষিজমি, শ্রমবাজার নষ্ট হয়েছে। বেড়েছে খাদ্য পণ্যের দাম। রোহিঙ্গাদের বর্জ্যরে কারণে শত শত একর কৃষিজমি অনাবাদি পড়ে আছে। জন্মসনদ ও জাতীয়তা সনদ নিতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয়রা।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের কারণে অতিরিক্ত জনচাপ ছাড়াও ক্যাম্পের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুন, গুম ও অপহরণের মতো নৃশংস ঘটনা নিয়মিত ঘটেছে। সবশেষ গত ১৮ আগস্ট এক যুবককে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া কুতুপালং বাজার থেকে ১৫ বছরের এক কিশোরকে অপহরণ করে মারধর ও গলায় চাকু ধরে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটেছে। ফলে এলাকায় নিরাপদে বসবাস কঠিন হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে আরাকান আর্মির রাখাইনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে জান্তার সঙ্গে সংঘাত, ত্রাণ তহবিল কমে যাওয়াসহ নানা কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের স্বপ্ন ‘কঠিন’ হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন রোহিঙ্গা নেতারা। নিজেদের সংগঠিত রাখার লক্ষ্যে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিতরা গত ১৬ আগস্ট অনানুষ্ঠানিক ভোটের মাধ্যমে পাঁচজন নেতা নির্বাচিত করেছেন। তারা হলেন ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মৌলভী সৈয়দ উল্লাহ, ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের খিন মং, ১ নম্বর ইস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জাহাঙ্গীর আলম, ১ নম্বর ওয়েস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মোহাম্মদ শোয়াইফ এবং ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাজেদা বেগম। নির্বাচিতদের নাম ঘোষণা করেন রোহিঙ্গা কমিউনিটি শিক্ষক মাস্টার মোহাম্মদ কামাল। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে অনুষ্ঠিতব্য সবচেয়ে বড় সম্মেলনে তারা রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে জানা গেছে।
রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য অধিকার, মর্যাদা এবং সমতার সঙ্গে নিজেদের মাতৃভূমি আরাকানে ফেরার স্বপ্ন পূরণ করা। সে লক্ষ্যে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন যাত্রা শুরু করেছি। রোহিঙ্গারা আজীবন বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস গত রমজানে আমাদের যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আমরা আশাবাদী তিনি কিছু করবেন। তার ওপর আস্থা রাখতে চাই।’
পচা বর্জ্যে আবাদি জমি অনুপযোগী
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী এলাকার চাষাবাদের জমিগুলো এখন আর আবাদযোগ্য নেই। রোহিঙ্গাদের ফেলা বর্জ্যে এসব জমি পরিণত হয়েছে পরিত্যক্ত পচা-বনে। একাধিক কৃষকের অভিযোগ, জমি আবাদ অযোগ্য হয়ে পড়ায় জীবিকা নির্বাহে তারা চরম সংকটে পড়েছেন। হ্নীলা ইউনিয়নের পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. আলী বলেন, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্যাম্পের আশপাশের জমিগুলোতে ময়লা-আবর্জনার কারণে চাষাবাদ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তা ও বাজারে নিয়মিত সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এসব কারণে এখানকার মানুষ অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে।
টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, আরাকান আর্মির সশস্ত্র সংঘর্ষের ঘটনা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যাতে প্রভাব না ফেলে, সে বিষয়ে যথাযথ সীমান্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই। সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। আমাদের সীমান্ত সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, বাংলাদেশের প্রতি পুরো রোহিঙ্গা জাতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু বাংলাদেশ চাইলেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে না। সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়ে এ সমস্যা সমাধান করতে পারবেন। আমরা আশা করছি আগামী রমজানে রাখাইনে গিয়ে ঈদ পালন করতে পারব।
২৫ আগস্টকে রোহিঙ্গারা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে উল্লেখ করে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, দিনটিতে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস পালনের মাধ্যমে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় তারা। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারাধীন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি চায় রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ঢলের ৮ বছর পরে এসে সরকারি-বেসরকারি এনজিও, আইএনজিও ও যেসব দাতা সংস্থা কাজ করছে তারা এখন ক্লান্ত। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এখন সরে গেছে। শরণার্থীদের বার্ষিক বরাদ্দও কমে এসেছে। এসব কারণে সংকট দিন দিন বাড়ছে।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম