পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুর সুরাহা হলো না
সমাধান হয়নি যে চার বিষয়
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে এখনও কিছু বিষয় অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার দায় স্বীকার ও আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাওনা অর্থ ফেরত এবং আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যর্পণের মতো গুরুতর ইস্যু প্রতিবার আলোচনায় এলেও সমাধান হয়নি। জুলফিকার আলী ভুট্টো থেকে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ হয়ে ইসহাক দার- সব সফরেই দুঃখ প্রকাশে সীমাবদ্ধ থেকেছে পাকিস্তান, পূর্ণ দায় স্বীকার আর স্পষ্ট ক্ষমা এখনও অধরাই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অমীমাংসিত ইস্যুর অগ্রাধিকারে রয়েছে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্ন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে যে গণহত্যা, নারীর ওপর ভয়াল নির্যাতন ও গ্রাম-শহরের ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল; সেটির জন্য আজও পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। কেবল ‘দুঃখ প্রকাশ’ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থেকেছে তাদের অবস্থান। অথচ বাংলাদেশের কাছে এটি শুধু রাজনৈতিক প্রশ্ন নয়, বরং ন্যায়বিচারের দাবি। দ্বিতীয় বড় ইস্যু হলো ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রশ্ন। ১৯৭২ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে তাদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হলেও ইসলামাবাদ কখনও বিচার করেনি। বাংলাদেশের কাছে এটি অমীমাংসিত ক্ষত হিসেবেই রয়ে গেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে নায্য অর্থনৈতিক দাবি- পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাংলাদেশের রিজার্ভ ফান্ড, করাচি ও লাহোরে জমা রাখা বিনিয়োগ এবং অন্যান্য সম্পত্তির বকেয়া, যা ফেরত পায়নি ঢাকা।
প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি সমপরিমাণ এই সম্পদের প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী ইস্যু হলো- আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যর্পণ। মুক্তিযুদ্ধের পর যারা বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিলেন, তাদের একটি বড় অংশ পাকিস্তানে যেতে চাইলেও পাকিস্তান তাদের গ্রহণ করেনি।
১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা সফরে আসেন। স্বাধীনতার পর এটাই ছিল উচ্চপর্যায়ের প্রথম সফর। পাকিস্তান ওই সফরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেয়। একই সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী সেনার বিচার প্রসঙ্গ, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যর্পণ ও নায্য অর্থনৈতিক হিস্য। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের অপরাধের দায় স্বীকার ও ন্যায়বিচারের বিষয়ে জোর দিলেও ভুট্টো বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি কেবল দুঃখ প্রকাশ করেন; কিন্তু কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। অর্থনৈতিক সম্পদ ফেরতের প্রশ্নে প্রতিশ্রুতি দেন আলোচনার, কিন্তু বাস্তবে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে ভুট্টোর সফরে বড় কোনো অমীমাংসিত প্রশ্নের সমাধান আনতে পারেনি।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এরপর বহু বছর পেরিয়ে যায়, আরেকটি উচ্চপর্যায়ের সফর হয় ২০০২ সালে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তখন বাংলাদেশে আসেন। দীর্ঘ বিরতির পর এ সফরে দুই দেশের মধ্যে এক নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয় বটে, তবে পুরনো প্রশ্নগুলো আবার সামনে চলে আসে। মোশাররফ তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, ১৯৭১ সালে যা ঘটেছিল তার জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করছেন। কিন্তু এই দুঃখ প্রকাশও ছিল সীমিত ও শর্তযুক্ত। তিনি কোনোভাবেই পাকিস্তানি সেনাদের অপরাধের দায় স্বীকার করেননি। বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল পাকিস্তান সরাসরি ক্ষমা চাইবে, কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
মোশাররফের সফরে বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা হয়। পাকিস্তান কিছু পণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, তবে বাংলাদেশের প্রধান অভিযোগ, তাদের রপ্তানিপণ্যের ওপর অশুল্ক বাধা তখনও বহাল থাকে। ফলে বাণিজ্য বৈষম্য দূর হয়নি। এ ছাড়া আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ইস্যু আবারও আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানকে তাদের দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানালেও মোশাররফ আশ্বাস দেওয়া ছাড়া বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেননি। পাওনা অর্থ ফেরতের প্রশ্নেও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ দেখা যায়নি।
২০২৫ সালে এসে ইতিহাস যেন নিজেকে আবারও পুনরাবৃত্ত করছে। সফররত পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায় এসে বললেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান আসলে ‘দুইবার হয়ে গেছে’- একবার ১৯৭৪ সালে ভুট্টোর সফরে, আরেকবার ২০০২ সালের শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট মোশাররফের সফরে। ইসহাক দারের দাবি, মোশাররফ বাংলাদেশের উদ্দেশে সমগ্র পাকিস্তান জাতির পক্ষ থেকে বার্তা দিয়েছিলেন, যা সমাধান হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা।
তবে ঢাকার অবস্থান ভিন্ন। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন স্পষ্ট করে বলেন, আমি অবশ্যই একমত না। একমত হলে তো সমস্যাটা সমাধান হয়ে যেত তাদের মতো করে, তাই না? আমরা আমাদের অবস্থানটা বলেছি, ওনারা ওনাদের অবস্থানটা বলেছেন। অর্থাৎ, বাংলাদেশের কাছে এসব ইস্যুর সমাধান কেবল দুঃখ প্রকাশে সীমিত নয়, বরং স্পষ্ট ক্ষমা প্রার্থনা, পাওনা অর্থ ফেরত, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যর্পণের মধ্য দিয়েই সম্ভব।
অতএব, ভুট্টো ও মোশাররফ থেকে ইসহাক দার- তিন সফরেই বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও পাকিস্তানের অবস্থানের মধ্যে ছিল সুস্পষ্ট ফারাক। মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার দায় স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা, পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাওনা সম্পদ ফেরত এবং আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়ার ইস্যু প্রতিবারই আলোচনায় এসেছে, কিন্তু সমাধান হয়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ায় এ সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে ইসহাক দারের বক্তব্য প্রমাণ করেছে, দুই দেশের অবস্থানের মধ্যে এখনও বিস্তর ফারাক রয়ে গেছে।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর আমাদের সময়কে বলেন, একাত্তরে পাকিস্তান যে অপরাধ করেছে, সেই অপরাধের কোনো তামাদি নেই। ওরা যদি মনে করে, একাত্তরের গণহত্যার দায় তাদের আছে এবং তারা স্বীকার করে, তাহলে আনুষ্ঠানিকভাবে আরেকবার তাদের সেই দায় স্বীকার করতে সমস্যা কী?
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
এম হুমায়ুন কবীর বলেন, এটা এখন আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হওয়া দরকার। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে বেদনা আছে, যে কষ্ট আছে, তা নিরসন হওয়া দরকার। অন্যদিকে যেহেতু আমরা স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর দুই দেশই পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসছি। এখনকার বাস্তবতার আলোকে সম্পর্কও স্বাভাবিক করতে হবে। এখন আমাদের দাবি আদায়ের জন্য অব্যহত চেষ্টা করব। আশা করি, তারাও সেটা মেনে নেবে। জাতীয় স্বার্থকে মাথায় রেখে এটাকে সামনে রেখে আমরা এগিয়ে যাব।
মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত আমাদের সময়কে বলেন, পাকিস্তান যদি আমাদের সত্যিই বন্ধুত্ব চায়, তাহলে একাত্তর সালে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, নারীর সম্ভ্রম নিয়েছে, তার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে। এ ছাড়া অন্যান্য অমীমাংসিত বিষয়গুলোরও দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।