নিজ ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করেন নাসার নজরুল

নিজস্ব প্রতিবেদক
২৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নিজ ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করেন নাসার নজরুল

নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার ছিলেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান। এই সুযোগে এক্সিম ব্যাংক থেকে ৬১৫ কোটি টাকা ফ্ল্যামিংগো এন্টারপ্রাইজ নামের একটি অস্তিত্বহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার নামে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরে এই অর্থ নাসা গ্রুপের ২০টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানান্তর করা হয়েছে। অভিনব প্রতারণ ও জালিয়াতির মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাতের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার পরিবারের সদস্য, নাসা গ্রুপ ও ব্যাংকটির কর্মকর্তাসহ ৩০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক বলছে, এক্সিম ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করতে নাসা গ্রুপের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই কাগুজে প্রতিষ্ঠান ফ্ল্যামিংগো এন্টারপ্রাইজের পক্ষে লেনদেন করতেন।

দুদকের উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম (জনসংযোগ) জানান, গত বৃহস্পতিবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ সংস্থাটির উপপরিচালক (ব্যাংক) আল আমিন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। নজরুল ইসলাম মজুমদার ছাড়াও এ মামলায় এক্সিম ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম স্বপন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফিরোজ হোসেন, ফ্ল্যামিংগো এন্টারপ্রাইজের ‘স্বত্বাধিকারী’ মো. মোশারফ হোসেনকেও আসামি করা হয়েছে।

জানা গেছে, বিগত সরকারের শেষ দিকে এই জালিয়াতি করা হয়। এমন কি গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১১ আগস্ট পর্যন্ত চলে এই জালিয়াতি।

মামলার এহাজারে বলা হয়, ফ্ল্যামিংগো এন্টারপ্রাইজের হিসাব ও লেনদেন বিবরণীসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা ও সার্বিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত সুবিধাভোগী নাসা গ্রুপের কর্ণধার ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার পরিবার। প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় লেনদেন নাসা গ্রুপের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে সম্পাদন করা হতো। আর ফ্ল্যামিংগো এন্টারপ্রাইজের নামে গৃহীত ঋণ নাসা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়েছে।

ফ্লামিংগো এন্টারপ্রাইজ নামে অস্তিত্বহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠানটি নাসা গ্রুপের ব্যবসায়িক তেজগাঁওয়ের ঠিকানা ব্যবহার করে ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়। এ তথ্য উল্লেখ করে এজাহারে বলা হয়, ৬১৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে কোনো সহায়ক জামানত গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি আমদানিকৃত পণ্যের স্টক পরিদর্শন বা প্রতিবেদনও প্রস্তুত করা হয়নি।

ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ না হওয়া সত্ত্বেও বারবার অর্থ ছাড় দেওয়া হয় এবং সেই অর্থ প্রকৃত ব্যবসায় ব্যবহার না করে পেপার ট্রাংজেকশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়, যার বেশির ভাগই নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন নাসা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ইস্যু করা হয়েছে।

এজাহারে আরও বলা হয়, এক্সিম ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব অনিয়ম সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও নিজেরা লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে ঋণ মঞ্জুরিপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে, ব্যাংকের বিনিয়োগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নীতিমালা নির্দেশিকা এবং শরিয়াহ পরিপালন না করে ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতির আশ্রয় নেন।

এর মাধ্যমে ব্যাংকটি থেকে ৬১৫ কোটি ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ অর্থের অবৈধতা, উৎস, অবস্থান, মালিকানা গোপন করতে বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং সংঘটিত হয়েছে বলেও মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে। ২০২৩ সালের ৩০ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট পর্যন্ত এ ঘটনা ঘটে।

এই মামলায় অন্য আসামিরা হলেন- নাসা বেসিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ালিদ ইবনে ইসলাম, আনিকা ইসলাম, মদিনা ডেটস অ্যান্ড নাটসের প্রোপ্রাইটর মোজাম্মেল হোসাইন, জান্নাত এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, এমএনসি অ্যাপারেলস লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবুল কালাম ভূঁইয়া।

এ ছাড়া এক্সিম ব্যাংক পিএলসির ম্যানেজার (এসভিপি) মোহাম্মদ আশরাফুল হক, এভিপি ও সেকেন্ড অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক এসপিও ও ইনভেস্টমেন্ট অফিসার মো. হুমায়ুন কাদের হিমু, সাবেক ম্যানেজার মো. মনোয়ার হোসেন, সাবেক এসভিপি মেফতা উদ্দিন খান, প্রিন্সিপাল অফিসার মো. শহিদুল ইসলাম, এসপিও মোছা. শিরিনা আক্তার, ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আরমান হোসেন, সাবেক এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনিছুল আলম, অ্যাডিশনাল ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (চুক্তিভিত্তিক) মো. ইছরাইল খান ও মো. মঈদুল ইসলাম, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাকসুদা খানম ও মো. জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, সাবেক অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর (চুক্তিভিত্তিক) শাহ মো. আব্দুল বারি ও মো. হুমায়ুন কবীরকেও আসামি করা হয়েছে।

অন্যদিকে আসামি হয়েছেন এক্সিম ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক ছয় পরিচালক। তারা হলেন- নাসরিন ইসলাম, মো. আবদুল্লাহ, মো. নুরুল আমিন, অঞ্জন কুমার সাহা, মো. নাজমুস ছালেহিন, মিয়া মোহাম্মদ কাওছার আলম।

আসামিদের বিরুদ্ধে দ-বিধি, ১৮৬০-এর ৪২০, ৪০৯, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ও ১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫ (২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।