বিভিন্ন উপসর্গে আসছে জ্বর, বাড়ছে দুর্গতি

মুহম্মদ আকবর
২৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বিভিন্ন উপসর্গে আসছে জ্বর, বাড়ছে দুর্গতি

রাজধানীর সবুজবাগ এলাকার রুহান নামের ৭ বছরের ছেলের জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট ফুলে যায়। এ নিয়ে মা-বাবা উদ্বেগে পড়েন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডেঙ্গু, কোভিড, কিডনি, লিভার ইত্যাদি টেস্ট করার পর সব রিপোর্ট নরমাল আসে। অবশেষে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবনেই জ্বর কমে যায়। কিন্তু ১০ দিন পর আবার জ্বর আসে। আবারও প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে জ¦র কমে বলে জানান তার বাবা রাহুল আনন্দ। একই এলাকার ২ বছর ৬ মাসের এক বাচ্চার ১ মাসে তিনবার জ¦র হয়। প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়ানোর পর সুস্থ হয়ে উঠেছে।

মিরপুর এলাকার পোশাকশ্রমিক ৩৭ বছর বয়সী সবুজ মিয়া প্রথম দিনেই জ¦রে কাহিল হয়ে পড়েন। শরীর-ব্যথায় উঠতে পারছেন না। তিন দিন পর জ্বর কমে গেলেও ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। টেস্টে ডেঙ্গু, কোভিড কিংবা চিকুনগুনিয়া কোনোটাই ধরা পড়েনি।

এভাবে একেকজনের জ্বর একেকরকম উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। অনেকে বুঝতেই পারছেন না কী থেকে জ¦র আসছে, কোন ধরনের জ¦র। রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল, ডায়াগনিস্টক সেন্টার ও মফঃস্বলের কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতি ঘরেই জ¦র হানা দিয়েছে। এক পরিবারের সবাই জ¦রে আক্রান্ত এমন খবরও আসছে। এতে মানুষের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ আর ভয়।

রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোয় জ¦রের রোগী প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ডেঙ্গু ও সিভিসি পরীক্ষা করাতে লম্বা সারি দেখা যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের সরকারি হাসপাতালেও জ¦রের রোগী আসছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসবের বেশির ভাগই ভাইরাল জ¦র। তারা পরামর্শ দিয়েছেন, দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই ভালো। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের জ¦র হলে হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে যেতে দেরি করা যাবে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার বংশবিস্তারের জায়গা ধ্বংস করা উচিত, কিন্তু এ নিয়ে সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেই। নেই রোগপ্রতিরোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান আমাদের সময়কে জানান, এ মুহূর্তে ৬ ধরনের ভাইরাসের উপস্থিতি দেখছেন তারা। সে হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যা করণীয়, যেমন সরকারি হাসপাতালে কম খরচে রোগ নির্ণয় পরীক্ষা করা, হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া, পরিস্থিতি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট স্থানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে পাঠানো, এসব করা হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকার নিয়ন্ত্রণ

বিষয়ে ম্যালেরিয়া নির্মূলের মতো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দেখছি না। ৬০ বছর আগে আমরা সফলভাবে মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে পেরেছি। এখন আধুনিক জ্ঞান রয়েছে, অথচ আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ১৭৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এ সময়ে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১১০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৭ হাজার ৯৯৫ জন। চলতি মাসে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ২৭ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছর জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩, জুনে ৫ হাজার ৯৫১ এবং জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১০, ফেব্রুয়ারিতে ৩, এপ্রিলে ৭, মে মাসে ৩, জুনে ১৯ এবং জুলাইয়ে ৪১ জন মারা গেছেন।

অন্যদিকে কোভিড সংক্রমণের পরিমাণ কমেছে। গত ২২ দিনে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। চলতি বছর ১৫৩৪৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ৩১ জন।

জানা গেছে, কোভিড ও ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে যারা মারা গেছেন তারা বেশিরভাগ জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন অথবা হাসপাতালে দেরি করে ভর্তি হয়েছিলেন।

বিএসএমএমইউর ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ জানান, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, এমনকি জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ একসঙ্গে চলছে। তার সঙ্গে টাইফয়েড ও প্যারা-টাইফয়েড জ্বরও দেখা দিচ্ছে। ফলে একেকজন রোগীর উপসর্গে ভিন্নতা থাকলেও প্রাথমিক ধাপ প্রায় একই। শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি। ফলে যাদের জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা বা গায়ে র‌্যাশ আছে, তারা অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। নিজে নিজে ওষুধ খেলে সমস্যা বাড়তে পারে। যারা বাসায় আছেন, তারা প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ বা পেইন কিলার খাবেন না। পানি, ডাবের পানি, ওরস্যালাইন বেশি করে খেতে হবে। জ্বরের এক থেকে তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গু টেস্ট করিয়ে নেওয়া ভালো। যদি বমি হয়, পাতলা পায়খানা হয়, খেতে না পারেন, তা হলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।