শর্তসাপেক্ষে বেতন বৃদ্ধির সুপারিশে কর্মীদের ক্ষোভ
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ৮৮৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি স্থায়ীকরণ ও বেতন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। দুই বছরের বেশি সময় পার হলেও তাদের নিয়মিত বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট কার্যকর হয়নি। অনিশ্চয়তার কারণে অনেকে চাকরি ছেড়েছেন। আর যারা রয়ে গেছেন, তারা মানসিক চাপে দিন কাটাচ্ছেন। কর্মীদের অভিযোগ, সরকারি প্রবিধান অনুযায়ী তাদের বেতন বাড়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে শর্তসাপেক্ষে মুচলেকা নিয়ে বেতন-ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বেবিচক। এই প্রস্তাবকে অযৌক্তিক দাবি করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কর্মীরা।
বেবিচকের চাকরি প্রবিধানমালা অনুযায়ী, নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করলে নিয়মিত বার্ষিক বেতন বেড়ে যাওয়ার কথা। চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১-এর ১১ (৩) ধারায় বলা আছে, দুই বছর পূর্ণ করা কর্মচারীরা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির আওতায় আসবেন। কিন্তু এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এতে দুই বছর পার করেও চাকরি স্থায়ী এবং বেতন বৃদ্ধি না হওয়া ৮৮৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের একজন কর্মী আমাদের সময়কে বলেন, দুই বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাদের বেতন বৃদ্ধি ও স্থায়ীকরণ কার্যকর হয়নি। যোগ্যতা থাকার পরও তাদেরকে বারবার বঞ্চিত করা হচ্ছে। এতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এই হতাশায় প্রায় ৩৫০ কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন।
বেবিচকের সাম্প্রতিক এক বোর্ডসভায় কর্মীদের স্থায়ীকরণ ও বেতন বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় নতুন যোগদানকারী যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দুই বছর অতিক্রম করেছেন, তাদের বার্ষিক বেতন বাড়ানোর বিষয়ে বোর্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সম্মত হলেও এতে কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ভবিষ্যতে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির কারণে কোনো কর্মকর্তা বা অডিট কর্তৃপক্ষ আপত্তি উত্থাপন করলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের প্রাপ্ত অর্থ ফেরত দিতে হবে। এ জন্য তাদের কাছ থেকে আগেই মুচলেকা নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত হয়, বেতন বৃদ্ধিসংক্রান্ত প্রবিধান শিথিলের বিষয়ে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে দ্রুত প্রস্তাব পাঠানো হবে। বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৭ সালের জনপ্রশাসন প্রবিধান অনুসারে প্রদত্ত নির্দেশনার প্রেক্ষিতে বেবিচক চাকরি প্রবিধানমালা, ২০২১-এর ১১ (৩) ধারা শিথিল করার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
এ বিষয়ে বেবিচকের সদস্য (প্রশাসন) আবু সালেহ মো. মহিউদ্দিন খাঁ আমাদের সময়কে বলেন, ৮৮৬ জনের চাকরি স্থায়ীকরণ বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। বিষয়টি মানবিক এবং অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে হতাশা কাজ করছে। আশা করছি, দ্রুতই সমাধান হয়ে যাবে।
তবে বোর্ডসভার এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কর্মচারীরা বলছেন, তারা চাকরিতে প্রবেশ করেছেন নিয়ম মেনে। প্রবিধান অনুযায়ী স্বাভাবিক নিয়মে যেটা পাওয়ার কথা, সেখানে মুচলেকা দিয়ে ভবিষ্যতে টাকা ফেরত দেওয়ার শর্ত মেনে নিতে হচ্ছে- এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং চাকরি প্রবিধানের লঙ্ঘন। তারা বলেন, বেতন বৃদ্ধি আটকে যাওয়ায় তাদের ব্যক্তিজীবনও বিপর্যস্ত হচ্ছে। তারা সমস্যার দ্রুত সমাধান চান। তাদের দাবি, বোর্ডের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে প্রবিধান অনুযায়ী ইনক্রিমেন্ট কার্যকর করতে হবে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে অডিট আপত্তির দায় কর্মচারীদের ওপর চাপানোর অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।
বেবিচক কর্মকর্তাদের একাংশ বলছেন, বিষয়টি জটিল হয়ে পড়েছে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কারণে। তারা জানান, ২০১৭ সালের জনপ্রশাসন প্রবিধানমালার আলোকে কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে, যা পরে বেবিচকের চাকরি প্রবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বেতন বৃদ্ধি কার্যকর করতে গেলেই অডিট আপত্তি আসতে পারে।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
বেবিচকের চাকরি প্রবিধানমালা অনুযায়ী, নবনিযুক্তদের শিক্ষানবিশকাল দুই বছর। এ সময় তারা মৌলিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন এবং অধিকাংশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। ফলে প্রবিধান অনুযায়ী শিক্ষানবিশকাল শেষ হওয়ার পর তাদের চাকরি স্থায়ী হওয়ার কথা এবং স্বাভাবিক নিয়মে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তবে নথিপত্র থেকে জানা গেছে, প্রবিধানমালার বেশ কয়েকটি ধারা এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।
প্রবিধানের ধারা ৮ অনুযায়ী, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সরকার যেভাবে নির্ধারণ করবে সেভাবেই দেওয়া হবে। আবার জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর ধারা ১০ (১)-এ বলা আছে; সকল কর্মচারীর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির তারিখ হবে প্রতি বছর ১ জুলাই। নতুন যোগদানকারী কর্মচারী যদি ন্যূনতম ৬ মাস চাকরি করেন তবে তিনি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন। অথচ চাকরি প্রবিধানমালা ২০২১-এর ধারা ৬ (৫) বলছে, অস্থায়ীভাবে সৃষ্ট পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি শিক্ষানবিশ হিসেবে গণ্য হবেন না। তবে অস্থায়ী পদ যেদিন স্থায়ী হবে, সেদিন থেকে তার চাকরিও স্থায়ী হবে। এ ছাড়া ধারা ১১ (৩) অনুযায়ী, কোনো শিক্ষানবিশ সফলভাবে শিক্ষানবিশকাল শেষ না করলে এবং চাকরিতে স্থায়ী না হলে তিনি বেতন বৃদ্ধির অধিকারী হবেন না।
এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত কর্মচারীদের মধ্যে অনাস্থা বাড়াবে। নীতিগতভাবে যেটি তাদের পাওনা, এতে শর্ত জুড়ে দিয়ে বা মুচলেকা নিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। বরং প্রবিধানে অসঙ্গতি থাকলে সেটি মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের যৌথভাবে সমাধান করা উচিত।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম