চার খাতে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি
দেশের বেশ কিছু খাতে গত বছর খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তৈরি পোশাক, বস্ত্র, নির্মাণ ও বাণিজ্যিক খাতে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে রয়েছে জাহাজ নির্মাণ খাত। দ্বিতীয় অবস্থানে চামড়া খাত।
এ ছাড়া বাণিজ্যিক, নির্মাণ ও বস্ত্র খাত রয়েছে যথাক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে। এসব খাতে খেলাপির হার ২৪ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। অথচ সার্বিক খাতে খেলাপির হার ছিল ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০২৪ পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খেলাপি ঋণ বাড়ার বেশ কয়েকটি কারণের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলো হলো- মেয়াদি ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণের সময় পুনর্নির্ধারণ, পরিদর্শন বিভাগ কর্তৃক বড় গ্রাহকদের ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা, গ্রাহকের চলতি ঋণ নবায়ন না হওয়া, পুনঃতফসিল ঋণ আবার খেলাপি হয়ে যাওয়া এবং বিদ্যমান খেলাপি ঋণ হিসাবের বিপরীতে সুদারোপ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ। তাদের ঋণ নিয়মিত রাখতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ বন্ধ হওয়ায় সব খাতেই তা লাফিয়ে বাড়ছে।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ। এক বছর আগে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ফলে গত বছর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ১২ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা।
আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে খাতভিত্তিক ঋণ বিতরণ এবং এর বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, উৎপাদনশীল শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে তৈরি পোশাক খাতে। গত বছর শেষে এ খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪৮ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এক বছর আগেও এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ, গত বছর এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা বা ১১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। অথচ ২০২৩ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। এই খাতটি খেলাপি ঋণের হারে বর্তমানে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।
২০২৪ সাল শেষে বস্ত্র খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩৬ হাজার ৫২০ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এক বছর আগে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ফলে গত বছর এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। এই খাতটি খেলাপি ঋণের হারে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
২০২৪ সাল শেষে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩১ কোটি টাকা। এটি এ খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। এই হার নিয়ে খাতটি এখন খেলাপি ঋণে শীর্ষে রয়েছে। আগের বছর এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ফলে খাতটিতে এক বছরে খেলাপিঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
এক বছরে চামড়া খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। গত বছর শেষে খাতটিতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এই হার নিয়ে খাতটি খেলাপি ঋণে এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। এক বছর আগে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ২৭ শতাংশ।
গত বছর সবচয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যবসা ও বাণিজ্য খাতে। ব্যবসা ও বাণিজ্য খাতে গত বছর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এই হারে খাতটি তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। ২০২৩ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ০৭ শতাংশ। ফলে গত বছর খাতটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫৭ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
২০২৪ সালে নির্মাণ খাতে ১৯ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা বেড়েছে খেলাপি ঋণ। এ সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এ খাতটি খেলাপি ঋণের হারে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। এক বছর আগে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৬৮ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প খাতেও গত বছর খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০২৪ সাল শেষে কৃষি খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আর কৃষিভিত্তিক শিল্পে খেলাপি বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ২১ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। এ ছাড়া গত বছর গৃহঋণে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭৫ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৭২ শতাংশ। ব্যক্তিঋণে খেলাপি বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ।