বিটিআরসির নিয়োগ-পদায়নে আইনবিধির বেশুমার লঙ্ঘন

শাহজাহান আকন্দ শুভ
১৮ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বিটিআরসির নিয়োগ-পদায়নে আইনবিধির বেশুমার লঙ্ঘন

আওয়ামী লীগের আমলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে আইন, বিধি লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। যোগ্যতা নয়, বরং ওই সরকারের প্রভাবশালীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগই ছিল মুখ্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যোগ্য কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে নিয়োগ-পদোন্নতি-পদায়ন করা হতো। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর একে একে বেরিয়ে আসছে বিটিআরসিতে আইন, বিধি লঙ্ঘনের নেপথ্যের অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিটিআরসিতে লাগামহীনভাবে যে অনিয়ম, দুর্নীতি হয়েছে এর তদন্তে গঠিত শে^তপত্র প্রণয়ন কমিটিও নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

সূত্র জানায়, বিটিআরসিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতিতে আইন বিধির লঙ্ঘন করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি তৎকালীন সরকার ও বিটিআরসি প্রশাসন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের শর্তানুযায়ী সরকারের সঙ্গে চুক্তি ছাড়াই ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুশফিক মান্নান চৌধুরীকে বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত ১২ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার তার নিয়োগ বাতিল করে। গত ৩০ জুলাই বিটিআরসি চেয়ারম্যানকে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছেÑ অধ্যাপক মুশফিক মান্নান চৌধুরী বিটিআরসির কমিশনার হিসেবে যে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন, তা নীতি বহির্ভূত কাজ। চিঠিতে কমিশনার পদে থেকে গৃহীত বেতন-ভাতাদি বাবদ তার কাছে বিটিআরসির পাওনা আদায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বিটিআরসির যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে আইন বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ হয়েছে, তাদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে বিটিআরসিতে সংযুক্ত করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের যে কোনো ‘সাইনিং পাওয়ার’ রহিত করতেও বলা হয়েছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বিটিআরসির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিবেদনের মতামত ও সুপারিশ বাস্তবায়নে বিটিআরসিকে উপরোক্ত নির্দেশ প্রদান করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।

জানতে চাইলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারী (অব.) গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, মন্ত্রণালয়ের চিঠি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আগামী সপ্তাহে কমিশন সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

টেলিযোগাযোগ বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনসহ একাধিক প্রতিবেদন বলছে, বিটিআরসির ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত নিয়োগ সার্কুলার মোতাবেক আগ্রহী প্রার্থীরা আবেদন করেন। কিন্তু সকল আবেদনকারীর আবেদন আমলে না নিয়ে শুধু বিটিআরসির প্রকল্পে কর্মরত ও জুনিয়র কনসালটেন্টদের কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ব্যতীত সরাসরি নিয়োগ প্রদান করা হয়। উক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বিটিআরসি প্রবিধান অনুসরণ না করে সিনিয়র সহকারী পরিচালক পদে (পদটি পদোন্নতি যোগ্য বলে উল্লেখ রয়েছে) সার্কুলার দেওয়া হয়। পরবর্তীতে নিয়োগপ্রাপ্ত উক্ত জুনিয়র কনসালটেন্ট ও প্রকল্প কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে বিটিআরসিতে।

২০২৩ সালে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে বিটিআরসির ওপর একটি কমপ্লায়েন্স অডিট পরিচালনা করা হয়। ২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি অডিট আপত্তি জারি করে প্রতিষ্ঠানটি। উক্ত পত্রে নিয়োগবিধি উপেক্ষা করে ২৯ জন জুনিয়র কনসালটেন্টকে রাজস্ব খাতে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ প্রদান, বয়স প্রমার্জনের ক্ষেত্রে সরকারি বিধি লঙ্ঘন, স্ট্রেংদেনিং দ্য রেগুলেটরি ক্যাপাসিটি প্রকল্পের ২১ কর্মচারীকে রাজস্ব খাতে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ প্রদান, চাকরি বিধিমালা ২০০৯ উপেক্ষা করে সিনিয়র সহকারী পরিচালক পদে মো. নূরুন্নবী ও বেগম সাবিনা ইসলামকে নিয়োগ প্রদানসহ আরও অন্যান্য বিষয়ে অডিট আপত্তি উত্থাপন করে। কিন্তু বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ উক্ত বিষয়ে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। উপরন্তু তৎকালীন চেয়ারম্যান জহুরুল হক (পরবর্তীকালে দুদক কমিশনার) এবং বিটিআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার উক্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতিসহ উক্ত সিন্ডিকেটকে শক্তিশালী করেন।

২০০৯ সাল থেকে শুরু করে গত বছর পটপরিবর্তনের আগ পর্যন্ত বিটিআরসির নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে অনিয়মের বিষয় তদন্ত করতে গত ১৬ মার্চ বিটিআরসির মহাপরিচালক আশীষ কুমার কুণ্ডকে সভাপতি করে একটি কমিটি করা হয়। কিন্তু উক্ত কমিটি কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। তবে ২০২১ সালে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ হতে যুগ্ম সচিব মুহাম্মদ আব্দুল হান্নানকে প্রধান করে গঠিত কমিটি তাদের দাখিলকৃত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেÑ বিটিআরসি সরকারি নিয়োগ বিধিমালা অনুসরণ না করে এমনকী বিটিআরসি প্রবিধানে উল্লেখ্য পদ সংখ্যা, পদের আলোকে শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়সের বাধ্যবাধকতা, সরাসরি নিয়োগযোগ্য পদ বিভিন্ন বিষয় অনুসরণ না করে উক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এ ছাড়া উক্ত প্রতিবেদনে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে পরিচালিত কমপ্লায়েন্স অডিট প্রতিবেদন ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে।