বিদেশে উচ্চশিক্ষার সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৬ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বিদেশে উচ্চশিক্ষার সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি

উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বর্তমানে প্রায় সব শিক্ষার্থী পাড়ি জমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। যা একজন শিক্ষার্থীকে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অর্জন, নতুন সংস্কৃতি আবিষ্কার এবং বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের সুযোগের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এ জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। বিদেশে উচ্চশিক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যে বিষয়গুলো জানা জরুরি তা বিস্তারিত তুলে ধরা হল

প্রথম ধাপ ভাষার দক্ষতা

বিদেশে উচ্চশিক্ষার যোগ্যতার প্রথম ধাপ ভাষার দক্ষতা। অধিকাংশ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে পড়াশোনার জন্য প্রয়োজন হয় ইংরেজি ভাষার। ইউরোপের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অন্য ভাষাতে দক্ষ হওয়ার প্রয়োজন হয়। এগুলোর মধ্যে প্রধান ভাষাগুলো হলো ম্যান্ডারিন চায়নিজ, জার্মান, ফরাসি, আরবি ও জাপানিজ। ইংরেজি ভাষার প্রশংসাপত্রগুলোর ক্ষেত্রে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাডেমিক আইইএলটিএস (ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম), টোয়েফল (টেস্ট অব ইংলিশ অ্যাজ এ ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ) গ্রহণ করে থাকে।

দেশ নির্বাচন

বিদেশে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই আপনাকে একটি দেশ নির্বাচন করতে হবে- যেখানে আপনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। নিজেকে উচ্চমানে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিদেশে উচ্চশিক্ষার বিকল্প নেই। তবে শুধু বিদেশ হলেই হয় না। কারণ সব দেশের শিক্ষার মান ও শিক্ষাব্যবস্থা এক নয়- এ বিষয়টি সবার আগে মাথায় রাখা উচিত। এশীয় দেশের মধ্যে মালয়েশিয়া ও চীন এবং ইউরোপের মধ্যে ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা, কোরিয়া, রাশিয়া, আমেরিকা ইত্যাদি দেশ মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। অনেকে আবার নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, হংকং, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাড়ি জমান।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন

একজন শিক্ষার্থীর সিজিপিএ ভালো থাকলে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন করা উচিত। একাধিক আবেদনে থাকবে চূড়ান্ত শিক্ষাবর্ষের থিসিস বা প্রোজেক্ট পেপার। গুরুত্বপূর্ণ নথিটির মাধ্যমে আরও ভালোভাবে অল্পকথায় পরিবেশন করতে হবে থিসিসের সম্ভাবনাময় দিকগুলো। এ আবেদনের মুহূর্তে প্রথম খেয়াল রাখতে হবে ভর্তির প্রয়োজনীয় নির্দেশনাগুলো ঠিকভাবে পড়া হচ্ছে কিনা। আবেদন সফল হওয়া এই নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে অনুসরণের ওপর নির্ভরশীল। এর জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের আদ্যোপান্ত ভালোভাবে দেখা উচিত। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আবেদনের জন্য সঙ্গত কাগজপত্রের শুধু ডিজিটাল কপি চায়; কিছু আছে ডিজিটাল স্ক্যান ছাড়াও পোস্টের মাধ্যমে ফিজিক্যাল কপি পাঠানোর নির্দেশনা দেয়।

মূল সনদ সংগ্রহে রাখা

আপনাকে শিক্ষা বোর্ড বা স্কুল-কলেজ থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মূল সনদ ও নম্বরপত্র সংগ্রহ করে রাখতে হবে। স্নাতকোত্তরের জন্য আবেদনের ক্ষেত্রে স্নাতকের মূল সনদ ও নম্বরপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হবে। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করার ক্ষেত্রে নিজ বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত খামে সনদ পাঠাতে হয়- এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সঙ্গে মূল সনদের সত্যায়িত কপি জমা দিতে হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে সনদ সত্যায়িত করে রাখতে হবে।

পাসপোর্ট তৈরি রাখা

উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা সময়ের আগে থেকেই পাসপোর্ট করে রাখা ভালো। কারণ বিদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোয় আবেদনের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট নম্বরের প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্নও হতে পারে। এ ছাড়া আইইএলটিএস, টোফেল, স্যাট, জিম্যাট, জিআরই পরীক্ষা দিতে পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে পাসপোর্টে নামের বানান অবশ্যই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সনদের মতোই হতে হবে। কারণ বানানের গরমিলের জন্য অনেকেই ভর্তি বা বৃত্তির আবেদন করতে পারেন না।

খরচ ও স্কলারশিপ

লেখাপড়া ও জীবনযাত্রা খরচের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। যদি নিজ খরচে পছন্দের কোর্স সম্পন্ন করতে চান, তা হলে আপনাকে অবশ্যই কোর্স সম্পন্ন করতে সর্বমোট কত খরচ হতে পারে এবং কীভাবে পরিশোধ করতে হবে- এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। আপনি চাইলে আপনার পছন্দকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইমেইল করে মোট খরচের একটি খসড়া হিসাব ও পরিশোধের পদ্ধতি জেনে নিতে পারবেন।

যারা স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যেতে ইচ্ছুক, তাদের বেশকিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমে দেখতে হবে স্কলারশিপের মেয়াদ কতদিন, সেটি নবায়ন করা যাবে কিনা। স্কলারশিপ যদি নবায়ন করাও যায়, তা হলে সেটি কী ধরনের যোগ্যতার ভিত্তিতে হবে- এটি জানতে হবে। স্কলারশিপের অর্থে কী কী খরচ করা যাবে, তা জেনে রাখাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

গবেষণা, বিশ্লেষণ ও নির্বাচন

বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে গবেষণা প্রয়োজন। প্রাথমিকভাবে কোর্স, বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের অবস্থানগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। কোর্সের ভেতরে কী কী অন্তর্ভুক্ত আছে, নির্দিষ্ট বিষয়টি নিয়ে গবেষণার সুযোগ, ক্যাম্পাসের জীবন ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাগুলো যাচাই করতে হবে। এর জন্য ক্যারিয়ার ও উচ্চশিক্ষাবিষয়ক সেমিনার, কাউন্সেলিং খুব কাজে লাগে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অথবা শিক্ষকদের কাছ থেকেও পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

ভর্তির শর্ত পূরণ

প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভর্তির শর্তগুলো থাকে। আপনি বিষয়ভেদে এবং কোন লেভেলে পড়াশোনা করতে যাবেন, এর ওপর নির্ভর করে শর্তগুলো। কোনো শিক্ষার্থীকে অবশ্যই প্রতিটি শর্ত পূরণ করতে হয়। শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা। যদিও ইউরোপের অনেক দেশে বিষয়টির ক্ষেত্রে শিথিল রয়েছে- তবুও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে আইইএলটিএস (IELTS), অনেক দেশে GRE, SAT, GMAT, TOFEL পরীক্ষার মাধ্যমে ভাষাজ্ঞান প্রমাণ করতে হয়।

ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু ও শেষ হওয়ার তারিখ

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য আবেদন করতে ইচ্ছুক, অবশ্যই সেখানে কোন তারিখে ভর্তির আবেদন শুরু হয় এবং কবে শেষ হয়- এ সম্পর্কে বিস্তারিত ও পরিষ্কার জ্ঞান রাখতে হবে।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্র দিতে হয়। আপনি সহজেই আপনার পছন্দকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা থেকে এ তথ্য জেনে নিতে পারবেন-

জাতীয় পরিচয়পত্র।

পাসপোর্টের কপি (বর্তমান ও আগের পাসপোর্টের ব্যবহৃত পাতা)।

আবেদন ফরম।

জন্ম সনদ।

সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির অনুমতি সংক্রান্ত চিঠি (কনফারমেশন অব এনরোলমেন্ট)।

স্বাস্থ্যবীমার প্রমাণপত্র।

শিক্ষাগত যোগ্যতা (সব বোর্ড পরীক্ষার সার্টিফিকেট) ও কর্মঅভিজ্ঞতার সনদ।

পূরণকৃত অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে (স্পন্সর বা গ্রান্টর) ফরম।

স্পন্সরের সঙ্গে আবেদনকারীর সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে জন্ম সনদ, পাসপোর্ট কিংবা স্কুলের কাগজপত্র।

স্পন্সরের আয়ের উৎসের বিস্তারিত কাগজপত্র।

সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করার ইতিহাস থাকলে সেখানে কাজের রেকর্ড ও ছাড়পত্র।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (১২ মাসের বেশি পুরনো নয়)।

বিবাহিতদের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী, সন্তানদের সম্পর্কে প্রমাণ হিসেবে জন্ম সনদ ও বিয়ের সনদ।

স্বামী-স্ত্রী কেউ মারা গিয়ে থাকলে বা বিচ্ছেদ হয়ে থাকলে মৃত্যু সনদ কিংবা বিচ্ছেদ সংক্রান্ত কাগজপত্র।

স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রমাণপত্র।