ইউজিসির প্রকল্পে লুটপাট-দুর্নীতি
উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ‘হায়ার এডুকেশন অ্যাকসেলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন’ (হিট) প্রকল্পে ভয়াবহ অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক অভিযোগ তুলেছেন- এই প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দে যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিকসংশ্লিষ্টতাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। ফলে অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ গবেষক বঞ্চিত হয়েছেন।
জানা গেছে, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার প্রভাব প্রকল্পের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাজনৈতিক পরিচিতি ও মতাদর্শকে প্রকল্প বাছাইয়ের প্রধান মানদ- হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
দেশের স্বনামধন্য পাঁচটি সরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক এমন অভিযোগ করে চিঠি দিয়েছেন ইউজিসির চেয়ারম্যানের কাছে। এই অভিযোগকারীরা চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত।
শিক্ষকদের তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেতাদের রাজনৈতিক পটভূমি ও প্রকল্প পাওয়ার উদাহরণ হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. গীতি আরা নাসরিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মির্জা তাসলিমা সুলতানা ও প্রফেসর ড. আইনুন নাহার, শাবিপ্রবির প্রফেসর মুহিবুল আলম, জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মোহাম্মদ রফিকুল ও ড. শফিকুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বিজন মোহন চাকি। তারা রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত এবং গবেষণার ক্ষেত্রে অনেকেই উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেননি।
অভিযোগকারী শিক্ষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এভাবে প্রকল্প বাছাই চলতে থাকলে দেশের উচ্চশিক্ষার মান, গবেষণার গতিশীলতা ও বৈদেশিক অনুদান ব্যয়ের স্বচ্ছতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অভিযোগ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ইউজিসির।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সালেকুল ইসলাম জানান, তারা ইউজিসির কাছে চার দফা দাবি পেশ করেছেন- এক. চলমান প্রথম ধাপের প্রকল্পগুলো চূড়ান্ত না করে স্থগিত রাখা। দুই. স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে অনিয়ম তদন্ত এবং নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ব্লাইন্ড রিভিউ সম্পন্ন করা। তিন. রাজনৈতিকসংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে অনিয়মে জড়িতদের অপসারণ ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ। চার. বিদ্যমান রিসার্চ প্রপোজাল ফরম্যাট বাতিল করে আন্তর্জাতিক মানের স্ট্যান্ডার্ড ফরম্যাট প্রণয়ন করা।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শিক্ষকদের চিঠির বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এসএমএ ফায়েজ আমাদের সময়কে জানান, তিনি অভিযোগ যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। ইউজিসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- গবেষণা উপ-প্রকল্পগুলো প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তিগত নয়; তাই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক নিয়োগ ও প্রভাব : প্রকল্প পরিচালনায় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে- সাবেক নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠনের সমর্থক শিক্ষকরা রিভিউয়ার ও প্রকল্প প্রাপক হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছেন।
গবেষণার নামে রাজনৈতিক পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন অভিযোগকারী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, গবেষণার নামে কোটি কোটি টাকা এমন ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, যাদের গবেষণা প্রোফাইল দুর্বল, কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয় শক্তিশালী। এটি জনগণের ঋণের অর্থের অপচয়।
অভিযোগকারী আরেক শিক্ষক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. গোলাম মাওলা বলেন, জুলাই বিপ্লবের পরও ফ্যাসিবাদী প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি উচ্চশিক্ষা খাত। যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যই বড় হয়ে উঠেছে। ফলে প্রকৃত গবেষকরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
রিভিউ প্রক্রিয়ায় তেলেসমাতি : শিক্ষকদের অভিযোগ- রিভিউ প্যানেলের সদস্যদের নাম, নিয়োগ পদ্ধতি ও যোগ্যতা গোপন রাখা হয়েছে। পিএইচডি ডিগ্রিবিহীন এবং গবেষণায় দুর্বল প্রোফাইলধারী ব্যক্তিরা রিভিউয়ার হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে একই বিভাগের শিক্ষক নিজের সহকর্মীর প্রকল্প রিভিউ করেছেন, আবার কেউ কেউ নিজেও প্রকল্প জমা দিয়ে রিভিউয়ারের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ব্লাইন্ড রিভিউ দাবি মিথ্যা : ইউজিসি দাবি করলেও, শিক্ষকদের মতে প্রকৃত ব্লাইন্ড রিভিউ হয়নি। রিভিউয়াররা আবেদনকারীর নাম, জীবনী ও প্রকাশনার তালিকা জেনেই মূল্যায়ন করেছেন। মূল্যায়নের নম্বর ও মন্তব্য প্রকাশ করা হয়নি, যা পুরো প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ করেছে।
নিয়মবহির্ভূত প্রেজেন্টেশন মূল্যায়ন : উইন্ডো-৩ ছাড়া অন্যান্য ক্যাটাগরিতে প্রেজেন্টেশনের কথা উল্লেখ না থাকলেও তা নেওয়া হয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প শুধু প্রেজেন্টেশনে দুর্বল মার্ক পাওয়ায় বাদ পড়েছে, অথচ বোর্ডে থাকা বিশেষজ্ঞরা সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে জানতেন না। যেমন নৃবিজ্ঞান ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকরা অর্থনীতি, আর্কিটেকচার বা প্রত্নতত্ত্বের প্রকল্প মূল্যায়ন করেছেন।
বিভাগভিত্তিক বৈষম্য : একই বিভাগের একাধিক প্রকল্প প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হলেও অঘোষিত নীতিতে একটি অনুমোদন ও অন্যগুলো বাতিল হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, রাজনৈতিক মতাদর্শ এখানে বড় ভূমিকা রেখেছে- জুলাই বিপ্লবে যুক্ত গবেষকদের প্রকল্প বাদ দিয়ে ফ্যাসিস্টপন্থি হিসেবে অভিযুক্তদের প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে।
যোগ্য গবেষক বঞ্চিত : বিশ্বমানের পিএইচডি ডিগ্রিধারী ও শতাধিক প্রকাশনার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনেক গবেষক বাদ পড়েছেন। এর বিপরীতে পিএইচডি না থাকা, সামান্য সাইটেশন ও প্রকাশনাসম্পন্ন গবেষকরাও কোটি টাকার প্রকল্প পেয়েছেন- যাদের অনেকেরই রাজনৈতিক প্রোফাইল উচ্চমানের। উদাহরণস্বরূপ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হালিমা বেগমের গবেষণা প্রোফাইল দুর্বল হলেও তিনি প্রকল্প পেয়েছেন।
অঞ্চল ও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বৈষম্য: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো প্রকল্প অনুমোদিত হয়নি। বিপরীতে সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থাকা কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে একাধিক প্রকল্প দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
জাতীয় অবদান উপেক্ষা : কোভিড-১৯ মহামারিতে জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখা শাবিপ্রবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ প্রাথমিকভাবে মনোনীত হলেও চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। অথচ যারা একই ক্ষেত্রে তেমন কোনো অবদান রাখেননি, তারা ফান্ড পেয়েছেন।
নৈতিকতার প্রশ্ন : বিশ্বব্যাংকের পূর্ববর্তী প্রকল্পের প্রায় একই শিরোনামে নতুন করে হিট ফান্ড পাওয়া- যেমন অধ্যাপক ড. গোকুল চন্দ্র বিশ্বাসের ঘটনা নৈতিক ও গবেষণা নীতির পরিপন্থি বলে অভিহিত হয়েছে। ডেডলাইন পরিবর্তন করে অনৈতিক সুযোগ ছিল- ঘোষিত সময়ের পর অতিরিক্ত ১২ ঘণ্টা দিয়ে প্রকল্প জমার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের সুবিধা দিতে করা হয়েছে।