কিন্ডারগার্টেন স্কুল কর্তৃপক্ষ নিবন্ধন নিতে অনাগ্রহী

এম এইচ রবিন
১১ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কিন্ডারগার্টেন স্কুল কর্তৃপক্ষ নিবন্ধন নিতে অনাগ্রহী

রাজধানীর সূত্রাপুর কাগজিটোলার একটি চার কক্ষবিশিষ্ট কিন্ডারগার্টেনে প্লে থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। প্রতিটি কক্ষে চার সারি টেবিলে গাদাগাদি করে বসা কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পাঠ নেয়। খেলার মাঠ দূরের কথা, স্বাভাবিক হাঁটার জায়গাও নেই। এমন অবকাঠামোহীন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেন ছড়িয়ে আছে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। নামের আড়ালে ‘ইংরেজি মাধ্যম’ কিংবা ‘আধুনিক শিক্ষা’র বিজ্ঞাপন দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান অভিভাবকদের আকৃষ্ট করছে। তবে সরকার ঘোষিত বাধ্যতামূলক নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে এখনও অনীহা রয়েছে অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের।

বছরের পর বছর সরকারি তত্ত্বাবধানের বাইরে থেকে আসা এসব প্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে সরকার ২০২৩ সালের নিবন্ধন নীতিমালা জারি করে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাবর্ষে জানুয়ারি থেকে অনিবন্ধিত স্কুল সরকারি বিনামূল্যের পাঠ্যবই পাবে না।

৬০ হাজারের মধ্যে নিবন্ধিত মাত্র ২০ শতাংশ : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধন নিয়েছে মাত্র ১০ থেকে ১২ হাজার কিন্ডারগার্টেন। অর্থাৎ প্রায় ৮০ শতাংশই এখনও নিবন্ধনের বাইরে।

নিবন্ধন পেতে উদ্যোক্তাদের অনীহার কারণ হিসেবে জানা গেছে, নিবন্ধনের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে জমি, খেলার মাঠ, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, স্যানিটেশন ও নিরাপত্তাসহ বেশ কিছু বাধ্যতামূলক শর্ত রয়েছে। কিন্তু বহু প্রতিষ্ঠান এখনও ভাড়া করা বাড়ি বা টিনশেডে চলছে। জমির শর্ত পূরণ বা মাঠ তৈরির সামর্থ্য নেইÑ এমনটাই বলছেন উদ্যোক্তারা।

মিরপুরের একটি কিন্ডারগার্টেনের মালিক নাজমুল হক বলেন, ‘আমরা ভাড়া করা ভবনে স্কুল চালাই। জমি বা মাঠ তৈরির খরচ সামলানো সম্ভব নয়। বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই।’

অন্যদিকে, গ্রামীণ স্কুলের উদ্যোক্তাদের মতে, জমি থাকলেও অবকাঠামো গড়তে অর্থের জোগান মেলে না। নিবন্ধনের ফি, নবায়ন ফি এবং সংরক্ষণ তহবিল জমা দেওয়াÑ সব মিলিয়ে আর্থিক চাপ অনেক বড়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. মিজানুর রহমান সরকার আমাদের সময়কে বলেন, ‘গুটিকয়েক অবকাঠামোহীন স্কুলের জন্য সবাই দায়ী হতে পারে না। তবে আমরা চাই, কেউ নিবন্ধনের বাইরে যেন না থাকে।’

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায় সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের সন্তানরা যে ধারা, যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করুক, এসব প্রতিষ্ঠানের সরকারি নিবন্ধন থাকাটা যৌক্তিক। তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানের সুবিধা-অসুবিধা, কী পড়ানো হয়, তাদের আয়-ব্যয় কী, শিক্ষায় তাদের সম্পৃক্ততাÑ সব তথ্যই সরকার জানতে পারবে।

সরকারের অবস্থান প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘নীতিমালার লক্ষ্য সব প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় এনে শিক্ষার মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নিবন্ধন ছাড়া আগামী বছর কোনো স্কুল সরকারি পাঠ্যবই পাবে না।’

এই ধরনের স্কুলের শিক্ষার মান প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত কনসালটেশন কমিটির আহ্বায়ক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ বলেন, ‘নিবন্ধনবহির্ভূত স্কুলে মাননিয়ন্ত্রণ না থাকায় শিশুর জ্ঞান ও সৃজনশীলতার ক্ষতির ঝুঁকি থাকে। অনেকে অতিরিক্ত বই চাপাচ্ছে, কেউ বা কেবল পরীক্ষামুখী শিক্ষা দিচ্ছে।’ তিনি ধাপে ধাপে শর্ত পূরণের জন্য ৩ থেকে ৫ বছরের রোডম্যাপ তৈরির পরামর্শ দেন।

নীতিমালার মূল শর্ত : ২০২৩ সালের নিবন্ধন নীতিমালায় শুরুতেই নির্ধারিত হয়েছে পাঠদানের অনুমতি, নিবন্ধন ও নবায়ন ফি। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহরভেদে এই ফি ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছেÑ পাঠদানের অনুমতির ফি ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা, নিবন্ধনের ফি ৮ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং নবায়নের ফি ৪ হাজার থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকা।

নীতিমালায় অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা হিসেবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ‘সংরক্ষণ তহবিল’। বিভাগীয় শহরে ১ লাখ, জেলা শহরে ৭৫ হাজার ও উপজেলা শহরে ২৫ হাজার টাকা জমা রাখতে হবে। ব্যক্তি নামের প্রতিষ্ঠান হলে এই তহবিল ৫ লাখ টাকা।

অবকাঠামোগত শর্তও কঠোর : প্রতিটি স্কুলের নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি থাকতে হবে। যেমনÑ বিভাগীয় শহরে ০.৮ শতক, জেলা শহরে ০.১২ শতক, উপজেলা শহরে ০.৩০ শতক জমি থাকতে হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষকে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, খেলার মাঠ, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত হতে হবে ৩০:১। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সাত সদস্যের ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকতে হবে। এ কমিটিতে একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক। দুই মাস অন্তর অন্তর সভা করা এবং সেই নথি সংরক্ষণ করাও শর্ত।

পাঠ্যক্রমের ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা : জাতীয় পাঠ্যক্রম ও এনসিটিবি নির্ধারিত বই পড়াতে হবে। সব আয়-ব্যয় নির্দিষ্ট তহবিলে রাখতে হবে এবং নিয়মিত অডিট করতে হবে।