সামনে বিপুল সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জও বিস্তর

আব্দুল্লাহ কাফি
১১ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সামনে বিপুল সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জও বিস্তর

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরোপিত পাল্টা শুল্ক বাংলাদেশের জন্য শেষ পর্যন্ত আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছে। ভারতের ওপর মার্কিন শুল্কহার সর্বশেষ ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে; চীনের ক্ষেত্রে বাড়তি ৫৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচিত দেশগুলোর ওপরও যে হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, তাতে করে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাওয়ার পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগও তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সেই তুলনায় সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি সচেতন থাকতে হবে সরকারেরও, দিতে হবে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা। সব মিলিয়ে একদিকে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনার হাতছানি, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জও কম নয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্কিন শুল্ক সুবিধা কাজে লাগাতে হলে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ, ব্যাংক-ঋণ সহজীকরণ, শুল্ক হয়রানি বন্ধসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা দূর করার পাশাপাশি সরকারের নীতি সহায়তাও প্রয়োজন। তাদের মতে, আগামী ছয় মাস বাংলাদেশের জন্য ‘এসিড টেস্ট’। এ সময়কালের মধ্যে যদি নিজেদের সমৃদ্ধ করা যায়, তাহলেই মার্কিন পাল্টা শুল্কের সুফল পেতে শুরু করবে বাংলাদেশ।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ট্রাম্পের শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য বড় স্বস্তির খবর। তবে এ অর্জনে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। কারণ, আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশের জন্য ‘সুবর্ণ সুযোগ’ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান অনন্ত গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএর সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, আমাদের কাছে অনেক অর্ডার আসছে। কিন্তু এই অর্ডার ধরে রাখার মতো সক্ষমতা কম। আমরা নিজেদের কারখানায় লাইন বাড়িয়ে মেশিন বসানোর চেষ্টা করছি। পাশাপাশি ওভারটাইমও বাড়ানো হচ্ছে। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ১১ মাসে দেশের মাঝারি ও বড় আকারের ১৬৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এসব কারখানা চালু হলে অনেক অর্ডার ধরে রাখা যাবে।

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, চীন ছাড়া অন্য দেশগুলোর জন্য প্রায় সমান হারে শুল্ক নির্ধারণ করা একটি ইতিবাচক দিক। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য এ শুল্ক ১৯-২০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় বিশ^বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা রক্ষা পেয়েছে। তবে এ সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হলে আমাদের উদ্যোক্তাদের আরও দক্ষ ও সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারলে ভবিষ্যতে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্ডার বাংলাদেশে স্থানান্তর হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মার্কিন পাল্টা শুল্কহার নিয়ে আমরা অস্বস্তিতে ছিলাম। এখন আমাদের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভারত ও চীনের ওপর অনেক হারে শুল্কারোপ হয়েছে। এ সুবিধা নিতে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিটিআরআই বলছে, ট্রাম্পের শুল্কারোপের ফলে মার্কিন বাজারে ভারতীয় পণ্যের দাম আরও অনেকটা বেড়ে যাবে। এর প্রভাবে রপ্তানি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণায় ভারত থেকে পণ্য ক্রয়কারী মার্কিন ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অনেকে ভারত থেকে পোশাক কারখানা অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার কথা পর্যন্ত ভাবছেন। কোনো কোনো কোম্পানি এরই মধ্যে ক্রয়াদেশও স্থগিত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক ব্র্যান্ড পার্ল গ্লোবালের কারখানা রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও গুয়াতেমালায়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পল্লব ব্যানার্জি রয়টার্সকে বলেন, সব ক্রেতাই এরই মধ্যে আমাকে ফোন করছেন। তারা চাইছেন, আমরা যেন ভারত থেকে অন্য দেশে উৎপাদন স্থানান্তর করি।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে চীন। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে ভারত, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। এর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে অন্য সব খরচ অপরিবর্তিত থাকলেও শুধু শুল্কের কারণে চীন ও ভারতের বদলে বাংলাদেশ থেকে একই পণ্য আমদানি করলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের খরচ কমবে ৩০ শতাংশের মতো।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। রপ্তানি খাতের প্রায় ১৮ শতাংশ অর্থ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এর মধ্যে ৮৫-৮৬ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কারোপের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি বাড়ার সুযোগ তৈরি হওয়ার পাশাপাশি ভারত ও চীন থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বাড়তি এ শুল্কের প্রভাবে মার্কিন বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়বে এবং এতে চাহিদা কমবে। এর পরও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায়, বিশেষ করে ভারত ও চীনের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকায় সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ সুযোগ পাকিস্তান, ভিয়েতনামও নিতে চাইবে। সেখানে এগিয়ে থাকতে আমাদের উৎপাদনশীলতা, শ্রমিকের দক্ষতা ও ব্যবসার পরিবেশকে আরও উন্নত করতে হবে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গতকাল বলেন, দেশের আর্থিক খাতে কেবল স্থিতিশীলতা এসেছে। রাজনৈতিক খাতে এখনও আসেনি। সবকিছু মিলিয়ে এখনই কেউ বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়বে- এমন প্রত্যাশা যদি কারও থাকে, আমি বলব সেটা কাল্পনিক। আমাকে বাস্তবসম্মত হতে হবে। সামনে নির্বাচন, এ মুহূর্তে হয়তো বড় কোনো বিনিয়োগকারী আসতে চাইবে না।

প্রসঙ্গত, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্ক হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ থেকে কমিয়ে ২০, কম্বোডিয়ার ওপর ৪৯ থেকে কমিয়ে ১৯, ভারতের ওপর ২৬ থেকে কমিয়ে ২৫, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর ২০ থেকে কমিয়ে ১০, পাকিস্তানের ওপর ২৯ থেকে কমিয়ে ১৯, শ্রীলংকার ওপর ৪৪ থেকে কমিয়ে ২০, থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ থেকে কমিয়ে ১৯, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ থেকে কমিয়ে ১৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।