জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি চলছেই
রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হচ্ছে না জনপ্রশাসন; পদোন্নতি-পদায়নে তদবির চলছেই। এসবের চাপে জেলা প্রশাসকসহ (ডিসি) গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন আটকে আছে। ছাত্র-জনতার প্রবল অভ্যুত্থানের জোয়ারে হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রত্যাশা ছিল যে, এ সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও বিভিন্ন দলের পরিচয়ে একের পর এক অনৈতিক চাপ আসতে শুরু করে। ইতিপূর্বে সুবিধাবঞ্চিত কর্মকর্তাদের দাবি-দাওয়ায়, স্লোগানে; প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তাদের নানা চাওয়া-পাওয়ার জেরে হাতাহাতিসহ ন্যক্কারজনক অনেক কর্মকাণ্ডও ঘটতে শুরু করে। এমন দাবিও আসে যে যোগ্য, মেধাবী ও দলনিরপেক্ষতা নয়, বরং পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দলীয় আনুগত্য যার যত বেশি রয়েছে, বিভিন্ন পদ-পদবিতে তাদের তত বেশি গুরুত্বসহকারে স্থান দিতে হবে। মওকা পেয়ে নৈতিক স্খলন, দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মে শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও বাগিয়ে নিতে শুরু করেন পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন। এক্ষেত্রে দলকানা কর্মকর্তারা শীর্ষ কর্মকর্তাদের কক্ষে প্রবেশ করে বেশ বীরদর্পে দলীয় পরিচয় দিতেও দ্বিধা করছেন না। শুধু তাই নয়, সর্বত্রই তারা দলীয় পরিচয়ের দাপটে সবাইকে তটস্থ করে তুলছেন।
অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি এবিএম আব্দুস সাত্তার শুক্রবার প্রশাসনবিষয়ক এক সেমিনারে বলেন, ‘আমি একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে বসি। গত বছর ৫ আগস্টের পর ওই অফিসে হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ভিড় করছেন। আমার বস তারেক রহমান ডেকে বললেন, ‘কী হচ্ছে? এরা কারা? তারা এখানে কী জন্য আসে?’ আমি বলেছি, এরা সবাই বঞ্চিত। এরা গত ১৫ বছর হাসিনার আমলে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। হাসিনার পতনের পর উচ্ছ্বাসে ছুটে এসেছেন ন্যায়বিচার পেতে। উনি বলেন, ‘দলীয় অফিসে ইন-সার্ভিস কর্মকর্তারা আসা ভালো লক্ষণ নয়। আপনি তাদের অফিসে আসতে নিষেধ করে দেন।’ আমি অফিসের গেটে নোটিশ টানিয়ে দিয়েছি। ইন-সার্ভিস কোনো কর্মকর্তা অফিসে আসতে পারবেন না। যদি কোনো সমস্যা থাকে, অফিসার্স ক্লাবে আসবেন।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি ও পদায়নে সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছিল। সে সময় যোগ্য, মেধাবী ও দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তারা পদে পদে বঞ্চিত হয়েছেন। সঙ্গত কারণেই প্রশাসনে যে চেইন অব কমান্ড থাকা সমীচীন, সেটিও ভেঙে পড়েছিল। তৎকালীন মন্ত্রীরা তাদের মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব নিয়োগ পেতে আধা সরকারিপত্র (ডিও লেটার) দেওয়া রীতি তো রেওয়াজে পরিণত করেছিলেন। বলা বাহুল্য, সিন্ডিকেটের সদস্যদের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে হতো সেই নিয়োগ ও পদায়ন।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার তিন দিন পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। ইতোমধ্যে এ সরকারের পথপরিক্রমা এক বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু হাসিনার আমলের অপসংস্কৃতি থেকে বের হতে পারেনি প্রশাসন। সেবা সংস্থার দপ্তরগুলোতে ঘুষ-অনিয়ম-দুর্নীতি, নাগরিক সেবা পেতে হয়রানি এখনও বন্ধ হয়নি। পদায়ন ও পদোন্নতিও চলছে ওই আমলের মতোই। এখনও পদোন্নতি-পদায়নে মোটা অংকের আর্থিক লেনদেনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এমনকি নিজের মন্ত্রণালয়ে পছন্দের সচিবকে পদায়ন না করায় খোদ উপদেষ্টা সেই সচিবকে তার মন্ত্রণালয়ে যোগদান না করতে দেওয়ার মতো কাণ্ড পর্যন্ত ঘটেছে।
হাসিনা সরকারের ফিটলিস্টে থাকা ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের (উপসচিব) জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে পদায়নের ঘটনা ঘটে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালনের শুরুর দিকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে সমালোচনা হওয়ায় পদায়ন হওয়া কয়েকজন ডিসিকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ সময় অভিযোগ ওঠে, এসব নিয়ন্ত্রণ করছেন চুক্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কতিপয় সিনিয়র কর্মকর্তা। ডিসি নিয়োগে বিতর্কের পর পরবর্তীকালে মন্ত্রণালয়ের পদোন্নতি-পদায়নেও সৃষ্টি হয় বিতর্ক। তখন প্রশাসনে সক্রিয়ভাবে গড়ে ওঠে একটি সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রীদের মতোই ডিও লেটারের সংস্কৃতি শুরু করেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গত শুক্রবার জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সেমিনারে এসব নিয়ে এন্তার অভিযোগ তোলা হয়েছে। সেমিনারে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয় উঠে আসে। আগামীতে যেন কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে তারা কাজ না করেন, সে আহ্বানও জানান কর্মকর্তারা।
সেমিনারে অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি এবং সাবেক সচিব আব্দুস সাত্তার অভিযোগ করে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার ‘সীমাহীন দুর্নীতি’র প্রমাণ তার কাছে রয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ ও পদায়ন হয় না।
হতাশার সঙ্গে তিনি বলেন, আমলাদের চরিত্র না হয় খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের রক্তের ওপর চেয়ারে উপবিষ্ট উপদেষ্টাদের সীমাহীন দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ তার কাছে রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এ নিয়ে বেশকিছু উদাহরণও তুলে ধরেন তিনি। তিনি যোগ করেন, গত এক বছরে দুর্নীতি না কমে বরং অতীতের চেয়েও বেড়েছে।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রাজনীতিতে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করার শুরুটা হয় আওয়ামী লীগ আমলে এইচটি ইমামের হাত ধরে। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের এটি পূর্ণতা পায়। দুজনই আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী সাবেক আমলা ও রাজনীতিবিদ।
আব্দুস সাত্তারের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বিবৃতি
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সেমিনারে আব্দুস সাত্তারের দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ করে গতকাল একটি বিবৃতি দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ। এতে তিনি বলেছেন, সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নজরে এসেছে, যেখানে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এবিএম আবদুস সাত্তার নাম উল্লেখ না করে কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। আমরা এসব অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। প্রমাণ উপস্থাপন বা ব্যক্তিদের শনাক্ত না করে ঢালাওভাবে অভিযোগ করা দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং জন-আস্থার জন্য ক্ষতিকর। আমাদের প্রশাসন স্বচ্ছতা, সততা ও জবাবদিহিতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদি তার কাছে কোনো অসদাচরণের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকে, আমরা তাকে আইনগত ও তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের কাছে তা দ্রুত জমা দেওয়ার আহ্বান জানাই।
উপদেষ্টাদের সততার ওপর পূর্ণ আস্থা আছে : মির্জা ফখরুল
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের সততার ওপর পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল শনিবার রাতে এক বিবৃতিতে তিনি দলের পক্ষে এ অভিমত ব্যক্ত করেন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আজকে একটি পত্রিকায় একজন সাবেক সচিবকে কোড করে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। উনি বলেছেন, আটজন অ্যাডভাইজার নাকি করাপশনে জড়িত। এটার সঙ্গে আমাদের (বিএনপি) কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা প্রধান উপদেষ্টাসহ এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব উপদেষ্টাকে অত্যন্ত সম্মান করি এবং তাদের ইনটিগ্রেটির ওপর আস্থা রাখি।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন