ঢাবির হলে প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন

ঢাবি প্রতিবেদক
১০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ঢাবির হলে প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ‘প্রকাশ্য ও গুপ্ত’ রাজনীতি নিষিদ্ধ রাখার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঘোষণা নিয়ে ক্যাম্পাসে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। চলছে নানা আলোচনা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের আগে এই ঘোষণা ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কোনো চেষ্টা হচ্ছে কিনা এই প্রশ্ন সামনে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যকার অঘোষিত প্রতিযোগিতার কারণেই আবাসিক হলে গুপ্ত ও প্রকাশ্য ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে কিনা এ প্রশ্নও উঠেছে। এই ঘোষণাকে কেউ কেউ ‘অপরিণামদর্শী ও চটকদার’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার গভীর রাতে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’র ব্যানারে বিক্ষোভে নামেন শিক্ষার্থীরা। 

রাত ১২টার পর স্যার এ এফ রহমান হল, মাস্টারদা সূর্য সেন হল, মুহসীন হল, রোকেয়া হলসহ বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা কমিটি ঘোষণার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন। তারা মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমবেত হন। সেখান থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন। 

একপর্যায়ে রাত ২টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান। তিনি জানান, গত বছরের ১৭ জুলাই আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা বহাল থাকবে। এ নীতিমালার অধীনে প্রতিটি হল প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। একই সঙ্গে তিনি ছাত্রদলের ঘোষিত কমিটি নিয়ে সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার কথাও জানান।

এছাড়াও রাত ৩টার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেন, হল পর্যায়ে সব রকমের প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি ‘১৭ জুলাইয়ের ফ্রেমওয়ার্ক’ অনুযায়ী নিষিদ্ধ থাকবে। এ ঘোষণার পর শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ হলে ফিরে যান। শুক্রবার রাতের ঘটনার পর গতকাল শনিবার দিনভর ক্যাম্পাসে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা ছিল। 

এদিকে আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ইস্যুতে গতকাল হল প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সঙ্গে বৈঠকে বসেন উপাচার্য ড. অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান। বৈঠক শেষে তিনি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি না রাখার বিষয়ে আগের সিদ্ধান্ত বহাল আছে। সিদ্ধান্ত কার্যকরে রোডম্যাপ তৈরি করতে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। 

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, অতীতে ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক ও অভিশপ্ত সংস্কৃতির কারণে শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি চায় না। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই তারা এখন চায় না আবাসিক হল কিংবা একাডেমিক এলাকায় কোনো ধরনের ছাত্ররাজনীতি থাকুক। এ বিষয়ে শিক্ষার্থী, সক্রিয় ছাত্রসংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ তিন পক্ষের যৌথ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা উচিত। কেবল আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষকের স্বাক্ষর নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করলেও তা শুধু প্রকাশ্য রাজনীতি বন্ধ করবে। প্রকাশ্য ও গুপ্ত উভয় ধরনের রাজনীতি বন্ধ করতে হলে সকল অংশীজনকে আলোচনায় বসে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড চালানোর অধিকার এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার জন্যই তো আন্দোলন হয়েছে। ডাকসু নির্বাচন হবে। সেখানে ছাত্রদলের প্রতি ঈর্ষান্বিত মনোভাব থেকেই কতিপয় রাজনৈতিক দল মব তৈরি করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক হলে এ ঘটনা (শুক্রবার রাতে বিক্ষোভ) ঘটিয়েছে। কর্তৃপক্ষকে ব্যাখ্যা দিতে হবে যে আবাসিক হলে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কী হবে। যারা খোলস ছেড়ে বের হতে পারে না তারা এবং লুকিয়ে থাকা ছাত্রলীগ- দুপক্ষই এর পেছনে আছে বলে মন্তব্য এই ছাত্র নেতার। 

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির ইসলাম জুবেল বলেন, প্রক্টরের পক্ষ থেকে হল রাজনীতি নিষিদ্ধের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তার এখতিয়ার ঘোষণাদাতার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। অভ্যুত্থানের পর একটি নৈতিক অবস্থান তৈরি হয়েছিল; কিন্তু গত এক বছরে ইসলামী ছাত্রশিবির ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ সেই অবস্থানকে নষ্ট করেছে। এখন যে অবস্থান থেকে হল রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলা হচ্ছে, সেটি কার্যকর কোনো সমাধান নয়। তিনি বলেন, দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও গুপ্ত রাজনীতি চলছে, যা আসলে ‘মুনাফেকির রাজনীতি’। এ ধরনের রাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই এটিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। 

প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নীতিমালা তৈরি করা দরকার। 

ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রশিবিরের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। হলে শুধু সেবামূলক কর্মসূচি রয়েছে। শিক্ষার্থীরা চাইলে আবাসিকের বাইরে রাজনীতি করবে। শিক্ষার্থীদের কাছে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এলাকায় কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেনি। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর আগেও মৌখিকভাবে অনেক ঘোষণা দিয়েছে। মৌখিক ঘোষণার ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এখন উচিত সকল স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বসে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি লিখিত নীতিমালা তৈরি করা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমল্লার বসু প্রশ্ন রেখে বলেন, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে যারা প্রকাশ্য রাজনীতি করে তাদের নেতিবাচকভাবে আর যারা গুপ্ত রাজনীতি করে তাদের ইতিবাচকভাবে দেখানো হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বা ফ্যাকাল্টিতে রাজনীতি না করে আমরা কি সচিবালয়ে গিয়ে রাজনীতি করব?

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রভোস্টরা হলে ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ডাকসু নির্বাচন এগিয়ে আসায় আবাসিক হলে সাংগঠনিক কার্যক্রম ছাড়া কীভাবে ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করবে সেই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সক্রিয় কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতারা বলছেন, যারা প্রকাশ্যে কমিটি ঘোষণা করে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা সম্ভব হলেও যারা গোপনে কার্যক্রম চালায় তাদেরকে কীভাবে নিষিদ্ধ করা হবে- সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

এদিকে গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তালি মিছিল করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে মিছিলটি শুরু হয়ে হলপাড়া হয়ে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসিতে) পায়রা চত্বরে অবস্থান নেয়। এ সময় বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ রায় সাহস, সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। এদিন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা কোনো ধরনের স্লোগান না দিয়ে শুধু হাততালি দিয়ে মিছিল করেন।

জাবিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আবাসিক হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন একদল শিক্ষার্থী। গতকাল রাত পৌনে নয়টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসানের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তারা বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ নিয়ে উপাচার্য মোহাম্মদ কামরুল আহসানের আলোচনার আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা ফিরে যান। এ সময় শিক্ষার্থীরা তার কাছে ছয় দফা দাবি জানান।