বিদায়ী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ পায়নি সরকার

২০২৪-২৫ অর্থবছরে নিট বিক্রি ঋণাত্মক ৬০০০ কোটি টাকা ।। ১২ মাসের ৬ মাসই ভাঙানোর প্রবণতা বেশি ছিল ।। চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগ বাড়ার আশা

জিয়াদুল ইসলাম
০৬ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বিদায়ী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ পায়নি সরকার

বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার। পুরো অর্থবছরে নিট বিক্রি (বিনিয়োগ) ঋণাত্মক হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি ছিল। এ নিয়ে টানা তিন অর্থবছর সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক হলো। সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ সরকারের ঋণ হিসেবে গণ্য হয় এবং তা বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যবহার করা হয়। মূলত গত তিন অর্থবছর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের এই দুর্দিনে সরকারকে ঋণের জন্য ব্যাংক খাতের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমূল্যস্ফীতি থাকায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের সঞ্চয় প্রবণতা কমে গেছে। এ ছাড়া আমানত ও সরকারের বিল-বন্ডের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ ব্যাংক ও বিল-বন্ডে স্থানান্তর হয়েছে। এসব কারণে নিট বিনিয়োগে প্রভাব পড়েছে। তবে সুদের হার বৃদ্ধি ও আয়কর রিটার্নমুক্ত বিক্রির সীমা বাড়ানোয় চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগ বাড়ার আশা করছেন তারা।

প্রতি বছরই বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে জাতীয় বাজেট পেশ করে সরকার। এ ঘাটতি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে মেটানো হয়। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে আছে ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র খাত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে বিক্রিতে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় সংশোধিত বাজেটে সেটি কমিয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে (জুলাই-জুন) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকার যে ঋণ পেয়েছে, তার চেয়ে এ পরিমাণ অর্থ বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মানুষের গড়পড়তা আয় কমে গেছে। ফলে যে পরিমাণ জমা রাখার কথা, তা রাখতে পারছেন না ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা। অন্যদিকে সম্পদশালীদের মধ্যে যারা নামে-বেনামে একসময় সঞ্চয়পত্রে বিপুল বিনিয়োগ করত, তাদেরও আগ্রহ কমেছে। ফলে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, গেল অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে ৬ মাসই সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক হয়। এর মধ্যে অক্টোবরে ৩ হাজার ২২৫ কোটি টাকা, নভেম্বরে ৩ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, ডিসেম্বরে ৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা, জানুয়ারিতে ৪ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা এবং জুনে ১৬৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে বাকি মাসগুলোতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় ছিল। এর মধ্যে গত অর্থবছরে জুলাইতে ২ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা, আগস্টে ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে ৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকা, মার্চে ৮০ কোটি টাকা, এপ্রিলে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা ও মেতে ১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা।

তথ্য পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, আগের দুই অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক ধারায় ছিল। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা। বিক্রি ধারাবাহিক কমতে থাকায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছিল। তবে পুরো অর্থবছরে নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক হয়েছিল প্রায় ২১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক হওয়ার পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা।

এদিকে আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির নিট লক্ষ্যমাত্রা আরও কমানো হয়েছে। এবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির নিট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি গত অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা কম। আর সংশোধিত বাজেটের চেয়ে দেড় হাজার কোটি টাকা কম।

জানা যায়, চলতি অর্থবছরে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র দাখিলের শর্ত শিথিল করা হয়েছে, আগে এই সীমা ছিল ৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া গত অর্থবছরের মাঝামাঝিতে এসে প্রতিষ্ঠান ব্যতীত ব্যক্তিপর্যায়ের সব সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে পুনর্বিনিয়োগ সুবিধা চালু করা হয়। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবের পুনর্বিনিয়োগ সুবিধা আবার চালু করা হয়। ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের বিনিয়োগসীমা প্রত্যাহার করা হয়। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মুনাফা তিন মাসের পরিবর্তে প্রতি মাসে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া গত জানুয়ারি থেকে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে একটি সীমা পর্যন্ত সুদের হার বাড়িয়েছে সরকার এবং এসব সুবিধা বাড়ানোয় আগামীতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে বলে আশা করছে।