হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠদের বেশির ভাগ মামলার তদন্ত চলছে
মানবতাবিরোধী ও দুর্নীতির ৪৫ অভিযোগ-মামলা ।। ট্রাইব্যুনালে ২২ মামলার মধ্যে একটির বিচার শুরু ।। দুর্নীতির অভিযোগে শতাধিক ব্যক্তির নামে মামলা
এক বছর আগে গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২২টি মামলা (মিস কেস) হয়েছে। এর মধ্যে ২১টি মামলার তদন্ত চলছে। এসব মামলায় শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা ও ঘনিষ্ঠসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি শেখ হাসিনাসহ তিনজনের নামে একটি মামলার বিচার শুরু হয়েছে।
টানা ১৫ বছরেরও বেশি শাসনামলে ক্ষমতার অপব্যবহার, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া ও পাচারের অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায় দুই ডজন অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এর মধ্যে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ছয়টি মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে। আরও তিনটি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে।
অন্যদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুকক।
এ ছাড়া দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আরও তিন ডজন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে ১৩৭টি বাস কেনায় দুর্নীতি এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের আলাদা দুটি অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে বলে দুদকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে ২২ মামলা : দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর পর প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার কাছে জুলাই আন্দোলনে হাসিনা সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এসেছে ৩৪০টি। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ২২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি ১৪১ জন। আসামিদের মধ্যে ৫৪ জন গ্রেপ্তার ও ৮৭ জন পলাতক আছে।
এসব মামলার মধ্যে ২ মামলায় শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। এক মামলায় তার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। গত রবিবার এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে এবং গতকাল দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এ মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আসামি করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ আল-মামুন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করে নিয়েছেন এবং এ মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছেন।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরেকটি মামলা হয়েছে গুমের অভিযোগে। মামলাটির তদন্তকাজ দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত বিস্তৃত ও জটিল বিষয়। এ অপরাধ দেশজুড়ে সংঘটিত হয়েছে। ফলে মামলার সাক্ষী ও তথ্য-উপাত্ত বিপুল। আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে তদন্ত শেষ করতে যুক্তিসঙ্গত সময় প্রয়োজন।
গ্রেপ্তার আসামি : মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন- আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, আমির হোসেন আমু, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ফারুক খান, শাজাহান খান, আব্দুর রাজ্জাক, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, কামরুল ইসলাম, জুনাইদ আহ্?মেদ পলক ও কামাল আহমেদ মজুমদার।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, জিয়াউল আহসান, মহিউদ্দিন ফারুকী, জসিম উদ্দিন মোল্লা, আবদুল্লাহিল কাফী, মইনুল ইসলাম, আলেপ উদ্দিন, মো. শাহিদুল ইসলাম, তানজিল আহমেদ, আবুল হাসান, মো. মাজহারুল ইসলাম, মো. আরাফাত হোসেন, মোহাম্মদ আরশাদ হোসেন, চঞ্চল চন্দ্র সরকার, মোহাম্মদ সুজন হোসেন, মুকুল চোকদার, হোসেন আলী ও আকরাম। তারা কারাগারে রয়েছেন। এ ছাড়া আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব জাহাংগীর আলম গ্রেপ্তার হয়েছেন।
দুদকের অনুসন্ধান-মামলা-বিচার : শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে পূর্বাচলে ছয়টি প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ায় দুদকের করা ছয়টি মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে। আরও তিনটি মামলার তদন্ত চলছে। এ ছাড়া দুর্নীতির এক ডজন অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। এ ছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখছে কমিশন। এসব বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হলেও প্রয়োজনীয় তথ্য এখনও আসেনি।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
সম্প্রতি দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, অনুসন্ধান কর্মকর্তারা নির্ধারিত সময়সূচি অনুসরণ করেই অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। তবে দেশের বাইরে থেকে প্রমাণ সংগ্রহে বিলম্বের কারণে কিছু অনুসন্ধান পিছিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে দালিলিক প্রমাণ হাতে এলেই অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তারা প্রতিবেদন জমা দেবেন।
গত বছর ৯ অক্টোবর আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও তার পরিবারের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগে চারটি মামলা করে দুদক।
গত ১ জানুয়ারি সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে ১৪৬ কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক।
গত ৩ জুন সালমান এফ রহমান এবং তার ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমানসহ ৩৯ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে দুদক।
গত বছর ১৯ ডিসেম্বর সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ১৩৭টি বাস কেনার অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম
দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, যেসব অনুসন্ধানের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ সম্পন্ন করা যায়নি, সেগুলো শেষ করতে কর্মকর্তাদের একটু বেশি সময় লাগছে। তথ্য পেলে যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করলে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।