অবশেষে পালিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা
অসংখ্য মানুষের রক্তে হাত রাঙিয়ে অবশেষে গত বছরের এই দিনে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছিল সেই ঐতিহাসিক দিন, যেদিন পতন ঘটে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ স্বৈরশাসনের। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীসহ বহু মানুষ এই দিনটিকে বলেন- ৩৬ জুলাই।
এদিন কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে রাজধানী ঢাকার অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করে লাখো মানুষ। সকাল থেকে রাজধানীর প্রবেশপথগুলোয় এসে ভিড় করে উত্তেজিত জনতা। ব্যারিকেট ভেঙে রাজধানীতে ঢোকার চেষ্টা করে। নিজের দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে সামরিক বাহিনী। শেখ হাসিনা বুঝে যান তার পতন অনিবার্য। দেশে থাকলে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে তাকে মরতে হবে। অবশেষে তিনি দেশ ছাড়তে রাজি হন। ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে একটি হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
জানা গেছে, গত বছর ৫ আগস্ট দুপুরে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর নিশ্চিত করার পর জনতার উল্লাস শুরু হয়। রাজধানীর রাজপথ দখলে নেয় লাখো মানুষ। বিক্ষুব্ধ জনতা শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবনে ঢুকেও বিজয় উদযাপন করে। বাদ যায়নি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জাতীয় সংসদ ভবনও। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ রাজপথে নেমে দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পতন উদযাপন করে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় তিন বাহিনীর প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন এবং দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। পরের দিন সকালে ঢাকায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম হতে পারে। তার (হাসিনা) বাসভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও জানান তারা। কিন্তু শেখ হাসিনা তাদের পরামর্শ নেননি। তিন বাহিনীর প্রধান শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন- আমাদের সৈন্যরাও দেশের অংশ। তারা গ্রাম থেকে এসেছেন। তারা নিজেদের লোকদের ওপর গুলি চালাবে না।
সূত্রগুলো বলছে, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট দুপুর থেকে ৫ আগস্ট সকাল পর্যন্ত গণভবনে কয়েকটি বৈঠকে শেখ হাসিনা আন্দোলন দমন করতে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে বলেন। সেনাবাহিনী প্রধানসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন- যা হওয়ার হবে, আমি ক্ষমতা ছাড়ব না। ৫ আগস্ট সকালে ঢাকা অভিমুখে ব্যাপক জনসমাগম শুরু হয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি সতর্ক করে বলেন- বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবনে পৌঁছালে এই ভিড়কে বেশি সময় আটকে রাখা সম্ভব হবে না, হয়তো সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শেষ মুহূর্তে সামরিক প্রধানরা সাহায্যের জন্য শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। তারা শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার সাথে কথা বলে বড় বোনকে চলে যেতে রাজি করাতে বলেন। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ফোনে মাকে দেশ ছাড়তে রাজি করান। সজীব ওয়াজেদ জয় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- ‘আমার মা মোটেও দেশ ছেড়ে যেতে চাননি। আমাদের তাকে রাজি করাতে হয়েছিল।’
৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় শেখ হাসিনার গতিবিধির খবর যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষ হাসিনাকে সড়কের পরিবর্তে হেলিকপ্টারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। তবে তিনি হেলিকপ্টারে চড়তে ইতস্তত বোধ করেছিলেন। পরে গণভবন থেকে একটি সামরিক বিমানে হাসিনা, তার বোন এবং আওয়ামী লীগের একজন এমপিকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণের জন্য একদিকে যেমন বিজয়ের দিন, তেমনি বেদনারও। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বিজয় উল্লাস করা ছাত্র-জনতার ওপর বর্বর হামলা চালালে অনেক মানুষ প্রাণ হারান। শেখ হাসিনার অনুগত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা এদিনও আন্দোলনরত কয়েকশ মানুষকে নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত করে।