এক বছরেও জনপ্রশাসনে ফেরেনি শৃঙ্খলা
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এই সময়ের মধ্যে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের পথে কমবেশি এগিয়ে গেলেও প্রশাসনিক অঙ্গনে গুণগত কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি। বরং প্রশাসন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও শাস্তি প্রদানের মতো প্রশাসনিক কার্যক্রমে চলছে ধীরগতি ও বিশৃঙ্খলা। নেতৃত্বের দুর্বলতা, সিদ্ধান্তহীনতা, নানামুখী তদবির, পদোন্নতি বঞ্চিতদের হতাশা ও ক্ষোভ, আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব এবং বিগত সরকারের আশীর্বাদপুষ্টদের অসহযোগিতার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে অবসর থেকে ফিরে আসা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দুর্বলতা ও প্রযুক্তিগত অদক্ষতায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রশাসন নিয়ে এমন দুরবস্থায় পড়তে হয়নি। গত এক বছরে প্রশাসনে গতি ফেরাতে বারবার কঠোর সতর্কতাসহ নানামুখী নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ও প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই প্রশাসনে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তে নেতৃত্বের দুর্বলতা দেখা গেছে। শুরুতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নিয়োগ চরম বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয় প্রশাসনে। কর্মকর্তারা নজরবিহীনভাবে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে প্রতিবাদের মুখে ডিসি হিসেবে ৯ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করা হয়।
দেখা যাচ্ছে, বিগত সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া সচিবসহ গ্রেড-১ কর্মকর্তারা এখনও বহাল রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। অথচ রাজনৈতিক কারণে যেসব মেধাবী কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশের ভাগ্যে ভালো পদায়ন আর জোটেনি। হাতেগোনা কয়েকজন সচিব পদোন্নতি পেলেও তারা রয়েছেন অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। এই সুযোগে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেন বিগত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট আমলারা। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত শিক্ষাসচিব সিদ্দিক জোবায়ের। যদিও তাকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় সরকার।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রশাসনের কেন্দ্রস্থলে ঘাপটি মেরে বসে থেকে সুকৌশলে সরকারের নানান কার্যক্রম ব্যাহত করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তাদের কারণেই প্রশাসনে উপসচিব থেকে সচিব পদে পদোন্নতির কোটাসহ জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা ছড়িয়ে পড়ায় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে।
প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে বিতর্ক আছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ৮২ ব্যাচের। এক থেকে দেড় দশক আগে অবসরে গেছেন। বর্তমান প্রশাসনের কাজকর্মের ধরন অনেক পাল্টেছে। সরকারের প্রতিটি দপ্তর এখন ডিজিটালাইজড। দক্ষতার সঙ্গে এসব সামলাতে পারছেন না অবসর থেকে পুনরায় কর্মস্থলে ফেরা কর্মকর্তারা।
সরকার জনপ্রশাসনে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ যুগ্ম সচিব ও তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের জন্য চারজন উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং জনপ্রশাসন সচিবকে নিয়ে ‘জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটি’ করে। এ কমিটি গঠনের পরই নিয়োগে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। কমিটির মতের সঙ্গে অন্য উপদেষ্টাদের তদবিরের অমিল দেখা দিচ্ছে। ফলে নিয়োগ-বদলিতে হচ্ছে বিলম্ব।
সূত্রমতে, যোগ্যতা অর্জনের পরও উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব এবং সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি না পাওয়ায় হতাশায় ভুগছেন প্রশাসনের অন্তত এক হাজার কর্মকর্তা। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির জন্য নিয়মিত হিসেবে ২৪ ব্যাচকে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই ব্যাচ ২০০৫ সালের ২ জুলাই চাকরিতে যোগ দেয়। বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডারের ১৯ কর্মকর্তাসহ এ ব্যাচের পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেছেন ৩৩৭ জন।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময় লেফট আউট হয়ে বঞ্চিত আছেন ৪৩ কর্মকর্তা। অন্যান্য ক্যাডারের যোগ্যতা অর্জন করেছেন ১৯৪ কর্মকর্তা। সব মিলিয়ে যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতির জন্য যোগ্যতা অর্জন করেছেন ৫৭৪ জন। সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দিতে নিয়মিত ব্যাচ হিসেবে ৩০ ব্যাচকে বিবেচনা করা হচ্ছে। লেফট আউটসহ প্রশাসন ক্যাডারের ৩১৯ কর্মকর্তা পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। এ ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের ২২৩ কর্মকর্তা ডিএস পুলে যোগ দিতে আবেদন করেছেন। এ মুহূর্তে দুই স্তরে পদোন্নতিপ্রত্যাশী কর্মকর্তার সংখ্যা এক হাজারের বেশি।
বর্তমান সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে জাহির করলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেই এখনও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মনমানসিকতা নিয়েই কাজ করছেন। ফলো প্রায়শই বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনের বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু সরকারি কর্মকর্তা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন, কলম বিরতিসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠন ও বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনে নামা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
সূত্রমতে, গত এক বছরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন সচিব ও রাতের ভোটের কারিগর ডিসিদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) এবং কাউকে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনকে বেছে নিয়েছিল প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা সেই সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সতর্কবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে একপর্যায়ে সরকার এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়। তবে প্রশাসনে গতি ফেরাতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।