কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থান
শান্তিপূর্ণ একটি ছোট আন্দোলন কীভাবে একটি রেজিমের পরিবর্তন ঘটাতে পারে, তার বড় উদাহরণ কোটা সংস্কার আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শুরু হওয়া এই আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানের রূপলাভ করে। এর মধ্য দিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই) প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। অবসান ঘটে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের।
কোটা সংস্কারের এই আন্দোলনকে কীভাবে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ দেওয়া যায়, তা গত বছরের ৪ জুলাই থেকে চিন্তা করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এদিন তিনি দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক ডাকেন। কীভাবে ছাত্রদের এই আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির সম্পৃক্ততা ঘটানো যায়, তার জন্য একটি মোক্ষম সময় খুঁজতে থাকেন তিনি। দলীয় বা অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের দলীয় ব্যানার ছাড়া ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে থাকেন তারেক রহমান। বিষয়টি টেরও পেয়েছিল হাসিনা সরকার।
সরকারের দিক থেকে বারবার বিএনপির সম্পৃক্ততার অভিযোগও তোলা হচ্ছিল। অবশেষে গত সাড়ে ১৫ বছর গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বিএনপি ও তার মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন পর সফলতার মুখ দেখতে পায়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী এই আন্দোলনে (১ জুলাই-১৫ আগস্ট পর্যন্ত) প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হন এবং প্রায় ২০ হাজার মানুষ আহত হন।
২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত জানুয়ারিতে যে গেজেট প্রকাশ করেছিল, তাতে মোট ৮৪৪ জনের নাম ছিল। নানা অসঙ্গতি থাকায় গত ৩ আগস্ট আটজনের নাম বাদ দেওয়া হয়। ফলে শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩৬ জনে।
গণ-অভ্যুত্থানের এই দিন সাড়ে নয় বছরের বেশি সময় পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য বাংলাদেশের গণমাধ্যম সরাসরি সম্প্রচার করে। দলীয় নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, বিজয়ীর কাছে পরাজিতরা নিরাপদ থাকলে বিজয়ের আনন্দ মহিমান্বিত হয়। বিজয়ের এই আনন্দঘন সময়, রাহুমুক্তির এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত শান্তভাবে উদযাপন করুন। অনুগ্রহ করে কেউ প্রতিরোধ-প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ হবেন না। কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। অর্জিত বিজয় যেন লক্ষ্যচ্যুত না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক এবং সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য আপনাদের প্রতি আহ্বান জানাই। ৫২, ৭১ কিংবা ৯০-এর মতো ছাত্র-জনতা আবার একটি বিজয়ের ইতিহাস রচনা করেছে- উল্লেখ করে তিনি দেশবাসীকে আবার বীরোচিত অভিনন্দন জানান।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকী একটি রিট করেন। পরদিন তারেক রহমানের বক্তব্য বা বিবৃতি সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়। গণ-অভ্যুত্থানের পর ২২ আগস্ট আগের সব নির্দেশনা প্রত্যাহার করেন হাইকোর্ট।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে (যেসব পদ আগে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি বলে পরিচিত ছিল) নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে; কিন্তু আদালত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এর পর কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের ৫ জুন আন্দোলন শুরু করে ঢাকাসহ দেশের ছয়টি বিশ^বিদ্যালয়। আলটিমেটাম শেষ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সংগঠিত হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের সরকারি বিজ্ঞপ্তি পুনর্বহালের দাবিতে ১ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করে।
আন্দোলনে শেখ হাসিনার অনুগত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা হামলা করে; কিন্তু ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে অকার্যকর হয়ে যায় তাদের দমন-পীড়ন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের ওপর গুলি না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। একদিকে দিনটি যেমন বিজয়ের, অন্যদিকে শোকেরও। এদিনও পুলিশ ও সরকার দলীয়দের বর্বর হামলায় অনেক মানুষ প্রাণ হারান।
পালানোর কদিন আগে ২২ জুলাই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে শেখ হাসিনা অহংকার করে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না’। কিন্তু সেই বক্তব্য দেওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে জনগণের প্রচ- ঘৃণা ও চাপের মুখে তাকে পালিয়েই যেতে হলো।
এদিন কারফিউ উপেক্ষা করে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি সফল করতে হাজার হাজার মানুষ রাজধানী ঢাকা অভিমুখে পদযাত্রা করেছিলেন। দেশজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসেন। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর নিশ্চিত করার পর জনতার উল্লাসে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। সেই মুহূর্তে শেখ হাসিনার ক্ষমতার আধিপত্য এবং আওয়ামী লীগের কথিত রাজনৈতিক দুর্গ এক মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে। এদিন বিক্ষুব্ধ জনতা শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জাতীয় সংসদে ঢুকে বিজয় উদযাপন করে।
২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর থেকেই শেখ হাসিনা ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতা’ ধরে রাখতে চেয়েছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণসহ নানা অনিয়ম ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি সমালোচনাকেও তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। গত বছর পতনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট সকাল থেকে রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়, নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। দুপুরের দিকে হাজার হাজার মানুষ শাহবাগে জড়ো হতে থাকেন। শেখ হাসিনা হঠাৎ দেশ ত্যাগ করার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে অনেক মানুষ নিহত ও আহত হন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা মূলত ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছিলেন; কিন্তু ৩ ও ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের নামে চালানো হামলায় যথাক্রমে- ৯৩ ও ৬৬ জন নিহত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা কর্মসূচির সময় এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করেন।
আন্দোলন যখন সহিংস হয়ে ওঠে, সমন্বয়করা সারাদেশে হত্যাকা-ের ঘটনায় দায় স্বীকার করে শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য ক্ষমা চাওয়াসহ বেশ কয়েকটি দাবি জানিয়েছিলেন; কিন্তু সরকার তা না করে আন্দোলন দমনের কৌশলেই অটল থাকে। তারা আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক- নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, নুসরাত তাবাসসুম এবং আবু বাকের মজুমদারকে তুলে নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রাখে। বাইরে থাকা কয়েকজন সমন্বয়ক তখন ৯ দফা ঘোষণা করে আন্দোলন চালিয়ে যান।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
ছয় সমন্বয়ক মুক্তি পাওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক জনসভায় শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি তুলে এক দফা ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। এতে আরও বেড়ে যায় দমন-পীড়ন। এর পর আন্দোলনকারীরা ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ দিনটিকে তারা ৩৬ জুলাই হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাদের মতে, শেখ হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাস শেষ হবে না।
অবশেষে আসে সেই ঐতিহাসিক দিন ৫ আগস্ট। ভোর থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও শহরতলি থেকে লাখ লাখ মানুষ রাজধানীর শাহবাগ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। ঢাকার বাইরে থেকেও হাজার হাজার মানুষ পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে রাজধানীতে আসার চেষ্টা করেন। তারা সব নিরাপত্তাব্যবস্থাকে পদদলিত করে গণভবনের দিকে এগোতে থাকে। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা উপলব্ধি করেন- এটাই তার বাংলাদেশের মাটিতে শেষ মুহূর্ত। তাকে বিদায় নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করেন। এর মধ্য দিয়ে তার দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে।