হাজার ছাড়িয়েছে শিল্পে গ্যাস সংযোগের আবেদন

লুৎফর রহমান কাকন
০৫ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
হাজার ছাড়িয়েছে শিল্পে গ্যাস সংযোগের আবেদন

গ্যাসের সংকটে বেহাল শিল্পকারখানা। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী গ্যাস মিলছে না। ব্যবসায়ীদের দৌড়ঝাঁপেও মিলছে না সুফল। ব্যবসা-বিনিয়োগে হতাশাজনক পরিস্থিতি চলছে। গত এক বছরে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার হার অত্যন্ত নিম্নমুখী। এদিকে শিল্পে গ্যাসের নতুন সংযোগের আবেদন পৌঁছেছে রেকর্ড পরিমাণ। দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে একটি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কাছেই আবেদন পড়েছে অন্তত এক হাজার ১০০টি। এসব আবেদনে সংযোগ কবে মিলবে তার নিশ্চয়তা নেই।

তিতাসের আওতাভুক্ত এলাকায় শিল্প, আবাসিক, বাণিজ্যিক, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য গ্যাসের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া নতুন শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে সব কিছু স্থবির হয়ে যাচ্ছে গ্যাসের সংকটে। পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে সরকার গ্যাস সংযোগ, লোড বৃদ্ধিসহ গ্যাসের সামগ্রিক ব্যবহারে লাগাম টানার চেষ্টা করছে। নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করেছে। ফলে অনেক বছর ধরে তিতাসে স্তূপ হয়ে চলেছে গ্যাস সংযোগ নেওয়ার আবেদন।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী জানা যায়, তিতাসে জমা পড়ে আছে অন্তত এক হাজার ১০০টি আবেদন। দীর্ঘদিন অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা এসব আবেদনের মধ্যে নতুন সংযোগ ছাড়াও রয়েছে লোড বৃদ্ধি এবং অন্যান্য বিষয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, শিল্প-মালিকরা দ্রুত গ্যাস সংযোগ চান। ফলে সরকার এসব আবেদনকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছে। যার মধ্যে প্রতিশ্রুত শিল্প সংযোগ, লোড বৃদ্ধি হবে এমন প্রায় ৫৫০টি। আর সম্পূর্ণ নতুন আবেদনের পরিমাণ আরও ৫৫০টি হবে। জ্বালানি বিভাগ, পেট্রোবাংলা এবং কোম্পানির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সরকারের একটি কমিটি বিভিন্ন শিল্পকারখানা পরিদর্শন করছে। ওই কমিটির রিপোর্টের প্রেক্ষিতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে। তিন শ্রেণির মধ্যে রয়েছে প্রস্তুত শিল্পকারখানা। যেগুলোতে সংযোগ দিলেই চালু হবে। এদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, টাকা জমা নেওয়া ও অন্যান্য কার্যক্রম অনুমোদন হয়েছে। আর ভবিষ্যতে কারখানা চালু করবে যারা তাদেরও আবেদন আছে। এ ক্ষেত্রে যাদের কারখানা প্রায় প্রস্তুত, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

এদিকে আমাদের সময়ের পক্ষ থেকে একাধিক শিল্প-মালিকের সঙ্গে কথা বললে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিল্পে গ্যাস সংযোগ এমন জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে কবে শিল্প-মালিকরা সংযোগ পাবেন বা তাদের কোম্পানির প্রতিশ্রুত লোড অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে পারবেন, কেউ জানে না। কোম্পানিগুলো, পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি বিভাগ মিলে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। কার সংযোগের জন্য কীভাবে অনুমোদন মিলবে কেউ জানে না।

একজন শিল্প-মালিক বলেন, তিতাসের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি, যে পরিমাণ চাপে গ্যাস পাওয়ার কথা, সেটার ধারে-কাছেও গ্যাসের চাপ নেই। সত্যিকার অর্থেই আমরা বিনিয়োগকারীরা মহাবিপদে আছি। আদৌ ভবিষ্যতে গ্যাস পাব কিনা, তার নিশ্চয়তা সরকারের কাছ থেকে নেই। সরকার বিগত দশ বছর ধরেই বলে আসছে গ্যাসের সমস্যা সমাধান হবে, কিন্তু হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাসের সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজানুর রহমান বলেন, শ্রেণিবিন্যাসের গুরুত্ব বিবেচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সংযোগ দেওয়া হবে। কমিটি কাজ করছে। সরেজমিন পরিদর্শন করে রিপোর্ট চূড়ান্ত করবে। আর যেগুলো ভবিষ্যতে আসতে চায়, তাদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমীক্ষা বিবেচনা করে তার পর চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জ্বালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিনই গ্যাস সংযোগের আবেদন জমা হচ্ছে। তবে এত সংযোগ দেওয়ার মতো অবস্থা সরকারের নেই। ফলে বিষয়টা দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। সরকার অল্প কিছু শিল্পকারখানার বিষয়ে দুয়েক মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলেও নতুন শিল্পকারখানায় সংযোগের ক্ষেত্রে আরও এক-দুই বছর সময় নিতে পারে। এ সময়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কিছু গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এলএনজি আমদানি করে গ্যাস সংকট সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবু চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা যাচ্ছে না। পেট্রোবাংলার হিসাবে বিদ্যমান গ্রাহকদের জন্য ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগান দরকার। সেখানে গড়ে ২৫শ থেকে ২৬শ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা যাচ্ছে।

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ পারভেজ আমাদের সময়কে বলেন, জ্বালানি বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অপেক্ষমাণ আবেদন যাচাই-বাছাই করছি। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আবেদনগুলো পেট্রোবাংলার মাধ্যমে জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়। আমরা জ্বালানি বিভাগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করব।

প্রসঙ্গত, দেশে এক দশক ধরে গ্যাসের সংকট চলছে। সরকার নানাভাবে রেশনিং করে গ্যাসের সরবরাহ করছে। সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা শর্ত ও বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়। বিতরণ কোম্পানিগুলোর সরাসরি শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেওয়ারও অনুমতি ছিল না এক সময়। শিল্পে গ্যাস সংযোগ পেতে জ্বালানি উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির অনুমোদন লেগেছে বিগত কয়েক বছর। এখনও শিল্পে গ্যাস সংযোগ, লোড বৃদ্ধিসহ যাবতীয় অনুমোদন নিতে হলে জ্বালানি বিভাগ গঠিত কমিটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রতিনিয়ত গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছে জ্বালানি বিভাগ।