বেসরকারি বিনিয়োগে হতাশা

শিগগিরই উন্নতির আশা নেই

জিয়াদুল ইসলাম
০৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বেসরকারি বিনিয়োগে হতাশা

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার বড় প্রভাব পড়েছে বেসরকারি বিনিয়োগে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ঋণপত্র (এলসি) কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশের নিচে নেমেছে, যা ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এর মধ্যেই চলতি অর্থবছরে বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা আরও কমিয়ে নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে প্রধান নীতি সুদহারও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ফলে আগামী ছয় মাস বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতির আশা নেই। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া, খেলাপি ঋণের আধিক্য ও তারল্য সংকট এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ ও নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগে ধীরগতি চলছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা।

সাধারণত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন বা সম্প্রসারণ করে থাকেন। ফলে এই পণ্যটির আমদানি বাড়লে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং সেরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বাড়ে। আর বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে, যার প্রভাব পড়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। ব্যাংকাররা জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ আমলের ব্যবসায়ীদের অনেকেই

আত্মগোপন করেছেন। আবার ডলার সরবরাহ পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি চলমান রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে কয়েক দফা নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েছে। এর প্রভাবে গ্রাহক পর্যায়ে সুদের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এতে উদ্যোক্তরা ঋণের চাহিদা কম করছেন। আবার উচ্চ খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর দিক থেকেও বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে আগ্রহের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে।

নতুন বিনিয়োগ কমার পেছনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে দায়ী করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে সবার আগে রাজনীতি ঠিক করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যদি থাকে তাহলে বিনিয়োগ হবে না। আবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি ঠিক না হয়, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো অসম্ভব। এমনিতেই নানা সংকটে বিদ্যমান কারখানাগুলোই যেখানে চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, সেখানে নতুন বিনিয়োগের সাহস কীভাবে দেখাবেন।

মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা হয়েছে মাত্র ১৭৪ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ কম। একই সময়ে পণ্যটির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯৮ কোটি ৫১ লাখ ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ দশমিক ৪২ শতাংশ কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি কমেছিল ২৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি খোলা কমেছে ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। একই সময়ে এই পণ্যটির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এ সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা সামান্য কমলেও নিষ্পত্তি বেড়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা সামান্য কমলেও নিষ্পত্তি কমেছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য খারাপ বার্তা দেয়। অর্থাৎ, নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগে আগ্রহ কমার পেছনে উচ্চ সুদের হারসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে। সুদহার কমানোর জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে দাবিও জানানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমানোর কৌশল হিসেবে সুদহার বাড়িয়েছিল। বিনিয়োগ না বাড়ার জন্য এটা অন্যতম কারণ। তাই বিনিয়োগ বাড়াতে হলে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার জন্য যা যা করণীয়, সেসব উদ্যোগ নিতে হবে।

বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে : গত অর্থবছরের জুনে বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। এটি ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নেমেছিল ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। অথচ করোনা মহামারির মধ্যেও বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশের ওপরে ছিল। বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগে যে ঋণগুলো বেনামে নেওয়া হয়েছে, পাচার করা হয়েছে। এই ঋণগুলো দেশের অর্থনীতিতে প্রকৃত অর্থে কোনো অবদান রাখেনি। অথচ এই ঋণের কারণে তখন বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি হয়েছে। আর এখন যেই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেটাই বেসরকারি ঋণের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি। যেটুকু চাহিদা আছে ততটুকুই হচ্ছে। অর্থাৎ বর্তমানে প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঋণ নিচ্ছেন না।

এদিকে চলতি অর্থবছরের জন্য বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে কমিয়ে নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন আগামী ডিসেম্বরে ৭ দশমিক ২ এবং জুনে ৮ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৯ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। মূলত দেশে করোনা মহামারীর পর থেকেই বেসরকারি বিনিয়োগে এক প্রকার ধীরগতি বিরাজ করছিল। এরপর আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর সঙ্গে যোগ হয় গত বছরের জুলাই অস্থিরতার প্রভাব। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।